বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

পূর্বাচলে ক্ষতিগ্রস্তদের ভোগান্তির শেষ নেই

প্লটের আবেদনপত্র গায়েব দালালদের দৌরাত্ম্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজিয়া খাতুন ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ২০০১ সালে রাজউকের পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় তিন কাঠার একটি প্লটের জন্য আবেদন করেন। আবেদনপত্র নম্বর ১৭৭৯৫। তিনি রাজউক থেকে প্লট পাননি। কেন পাননি তা জানতে রাজউকে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয়, এ ধরনের কোনো আবেদনপত্র রাজউকে জমা হয়নি। অথচ ওই আবেদনের সঙ্গে জমা দেওয়া পে-অর্ডার (১৬৩৫২০১ তারিখ : ২৯-৮-২০০১) রাজউক জনতা ব্যাংক শাখায় জমা হওয়ার তথ্য আছে। পরে তিনি তার আবেদন তালিকাভুক্ত করতে ১৩-৪-২০০৮ তারিখে রাজউক চেয়ারম্যান ও পূর্বাচল প্রকল্পের উপপরিচালক বরাবর পৃথক দুটি আবেদন করেন। কিন্তু সে আবেদনেও কোনো কাজ হয়নি। প্রতিকারের আশায় তিনি বিস্তারিত জানিয়ে তদানীন্তন প্রতিমন্ত্রী বরাবর ২০০৯ সালের ৭ জুলাই আবেদন করেন। প্রতিমন্ত্রী বিষয়টিকে গুরুতর অভিযোগ উল্লেখ করে ব্যবস্থা নিতে সচিবকে নির্দেশ দেন। কিন্তু তারপরেও কোনো কাজ হয়নি। রাজিয়া খাতুনের স্বামী স্কুল শিক্ষক কফিল উদ্দিন আহমেদ ১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন। রূপগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভার বিরাব গ্রামে বাড়ি তার। পেনশনের টাকা দিয়ে রূপগঞ্জের সুলফিনা মৌজায় নিজের নামে সাড়ে ১৭ শতাংশ এবং স্ত্রী রাজিয়া খাতুনের নামে সাড়ে ১৭ শতাংশ জমি কিনেন। ওই জমি পরে রাজউক পূর্বাচল প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করে এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন দুজনের নামে দুটি ক্ষতিগ্রস্ত অ্যাওয়ার্ড দেন। ২০০১ সালের রাজউকের প্লট বিক্রির বিজ্ঞাপনের পরিপ্রেক্ষিতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে পৃথক দুটি আবেদন করেন। একটি আবেদন রাজউক হারিয়ে ফেলে অন্যটি তালিকাভুক্ত আছে। কফিল উদ্দিন আহমেদের আবেদনপত্র নম্বর ১৭৭৯৬। কিন্তু তারা প্লট পাননি। অবশেষে দুটি আবেদন বিবেচনায় নিয়ে পাঁচ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ করতে ২০০৮ সালের ৩ আগস্ট প্রথম আবেদন করেন। পরে একই আবেদন আরও দুই দফা করেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সবশেষে তাদের বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় নিতে সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী রাজউকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীনকে অনুরোধ করেন। ওই অনুরোধের পর তাদেরকে আরও একটি আবেদন করতে বললে তারা আবেদন করেন। দুই দফা চাকরির মেয়াদ পার করে চেয়ারম্যান অবসরে চলে গেছেন। আর স্কুল শিক্ষক কফিল উদ্দিন আহমেদের আবেদন পড়ে আছে রাজউকে। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কত শত বার যে তারা রাজউকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন এর কোনো হিসাব নেই। ইতিমধ্যে কফিল উদ্দিন আহমেদ ইন্তেকাল করেছেন এ বছরের শুরুর দিকে। অথচ তাদের ভাগ্যে রাজউকের প্লট জুটল না। রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে নিজের জমি দিয়ে এমন হয়রানি আর ভোগান্তির মুখে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। রাজউকের পূর্বাচল সেলে গেলে বসত বাড়ি হারানো সর্বস্বান্ত মানুষের আহাজারি শোনা যায়। সেই সঙ্গে দালালদের নানা কৌশলের কাহিনীও আলোচনায় আসে। প্রকল্প এলাকার বেশ কিছু গ্রামের প্রায় এক হাজার আদিনিবাসী আর তিন হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এখনো পুনর্বাসন প্লট পায়নি। সব মিলিয়ে রূপগঞ্জ আর কালীগঞ্জ অংশের এখনো পাঁচ হাজার আবেদন রাজউকে জমা রয়েছে। এই ক্ষতিগ্রস্তরা প্লটের আশায় রাজউকে ঘুরছে দিনের পর দিন। এসব পুনর্বাসন প্লটের মধ্যে বেশ কিছু জালিয়াতি করে একটি সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। হাতিয়ে নেওয়া প্লট অল্প সময়ের মধ্যে আবার অন্যত্র হস্তান্তর করে অর্থ লুটে নিয়েছে সিন্ডিকেটের লোকজন। এলাকাবাসীর দাবি, রাজউকের এ প্রকল্পে স্থানীয় ইউসুফগঞ্জ, ভোলানাথপুর, পর্শি, ধামচি, গুচ্ছগ্রাম, জিন্দা, গোবিন্দপুর, কালনী, খাইলসা, কুলাদী, ব্রাহ্মণখালী, শিমুলিয়া, রঘুরামপুর, মাঝিপাড়া, পাঁচভাগ, মাইজগাঁও, কামারপাড়া, কেন্দুয়া, বাড়িয়ারটেকসহ প্রায় ৩০ গ্রামের অনেক লোক এখন নিঃস্ব অবস্থায় রয়েছে। কাঞ্চন এলাকার বাসিন্দা মাহফুজুল হক বাদল বলেন, দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম ফার্টিলাইজার কোম্পানিতে কর্মরত আছি। চাকরি করে কিছু টাকা জমিয়ে ১৯৮৯ সালে এক বিঘা জমি কিনেছিলাম। সেই জমি রাজউক অধিগ্রহণ করে নিয়েছে। আমাদের প্লট দেওয়ার কথা বলে আরও ৫০ হাজার টাকা তারা (রাজউক) জমা নিয়েছে। কিন্তু এখন রাজউকে ঘুরে ঘুরে হয়রান। প্লট পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও দেখছি না।

প্রায় সাড়ে ছয় হাজার একর জমির ওপর রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। অধিগ্রহণ করা এ পুরো জমিই ছিল রূপগঞ্জ আর কালীগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দাদের। এতে সরাসরি ১৩ হাজার ৯২৩ স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কেউ তাদের ফসলি জমি, আবার কেউ বসতভিটাসহ ফসলি জমি হারিয়েছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন নামমাত্র ক্ষতিপূরণ। কিন্তু রাজউকের এ প্রকল্প ঘিরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন অর্ধশত দালাল। এক সময়ের সাধারণ দালালরা এখন নতুন মডেলের গাড়ি, ঢাকায় আলিশান ফ্ল্যাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, পূর্বাচলে নামে-বেনামে অসংখ্য প্লটের মালিক। এর মধ্যে কিছু চিহ্নিত দালাল নিজেরাই ‘হাউজিং’ ব্যবসা শুরু করেছেন। তারা কর্মকর্তা-কর্মচারী না হলেও প্রতিদিন দামি গাড়িতে করে রাজউকে আসেন। দুপুরের খানাপিনাও সারেন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। কোনো কোনো কর্মকর্তা দালালদের গাড়িতেই নিজের বাসায় ফেরেন। সব মিলিয়ে রাজউকের পূর্বাচল সেল এখন অনেকটাই তাদের নিয়ন্ত্রণে। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজউকের পূর্বাচল সেল ঘিরে দালালদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এ দালালদের বেশির ভাগ রূপগঞ্জ ও কালীঞ্জেরে বাসিন্দা। এর মধ্যে শাহিন মালুম, মারফত, দেলোয়ার, ফারুক মালুম, দিলু, আনছার, রমজান, হাসমত, আফজাল, আনোয়ার, মজিবুর, আরমান, মামুন, রিপন, আলম, রাসেল, আরফানসহ অর্ধশত দালাল তত্পর রয়েছেন। তারা সবাই রাজউকের কোটিপতি দালাল হিসেবে পরিচিত। রাজউকের চিহ্নিত দালাল ভোলানাথপুরের দিল মোহাম্মদ দিলু এখন কোটিপতি। পূর্বাচল প্রকল্পে জমির দালালি করে বর্তমানে ‘নর্থ সাউথ হাউজিং’ নামের একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এ ছাড়া দিলুর পূর্বাচলে কমপক্ষে অর্ধশত প্লট রয়েছে বলে জানা যায়। আনছার আলী নামের একজনও পূর্বাচল সেলের পরিচিত নাম। তিনি রাজউকের পূর্বাচল সেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে অল্প সময়ের মধ্যেই অর্ধশত প্লটের মালিক হয়েছেন। এখন নিজেই আবাসন ব্যবসা খুলে বসেছেন। পূর্বাচল প্রকল্পের আরেক দালাল রূপগঞ্জের দাউদপুরের মারফত আলী। পূর্বাচলে প্লট জালিয়াতি আর ভুয়া দলিলের মাধ্যমে নামে-বেনামে প্লটের মালিক হয়ে তা বিক্রি করে এই মারফত আলী এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। তিনিও রাজউকেই ‘অফিস’ করেন। অফিসে আসা-যাওয়ার পথে তার গাড়িতে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মকর্তাকেই দেখা যায়। তাদের ভয়ে সাধারণ কর্মচারীরা মুখ খুলতে চান না। জাহের আলী নামের আরেকজনও পূর্বাচল প্রকল্পের কল্যাণে কোটিপতির কাতারে নাম লিখিয়েছেন। প্রচুর জমিও কিনেছেন এই ব্যক্তি। পূর্বাচলের দালাল হিসেবে পরিচিতি আছে তারও।

পূর্বাচল প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অনুমোদন ছাড়া সরকারি এ প্রকল্প ঘিরে অনেক ব্যক্তি আবাসন ব্যবসা খুলে বসেছেন। এশিয়ান ডুপ্লেক্স টাউন, পূর্বাচল হোমস গার্ডেন সিটি, ম্যানশন সিটি, ইউরো স্টার মডেল টাউন, এস এ সূচি, আদর্শ গ্রুপ, নিপবন, পূর্বাচল ইস্ট ভিউ সিটি, এনআরবি হোমস (পূর্বাচল), ট্রাস্ট পূর্বাচল সিটি, পূর্বাচল সোপান সিটি, সোপান হোমস, গ্রিন সিটি, পূর্বাচল বেস্টওয়ে সিটি, ইউরো বাংলা হাউজিং, পূর্বাচল মেরিন সিটি, রিডম পূর্বাচল, আদর্শ সিটি, ঢাকা ভিলেজ, ভুলুয়া রয়েল সিটি, রেড প্রপার্টিজ, স্যাটেলাইট টাউনসহ অনেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে পূর্বাচল প্রকল্প এলাকায়।

জমি অধিগ্রহণের সময় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের আদি অধিবাসীদের বলা হয়েছিল, তাদের জন্য প্লটের ব্যবস্থা হবে। উচ্ছেদের পর ক্ষতিগ্রস্তদের ‘অ্যাওয়ার্ড’ হিসেবে দেওয়া হয় একটি কাগজ, যা দেখিয়ে তাদের প্লট বুঝে নেওয়ার কথা। কাগজ নিয়ে গিয়ে রাজউক থেকে প্লটের নম্বর আনতে গেলেই এখন তাদের গুনতে হয় ছয় থেকে আট লাখ টাকা। এ টাকা ছাড়া রাজউকের পূর্বাচল সেল সেই ক্ষতিগ্রস্তদের কথাই শুনছে না। এ ছাড়া আমমোক্তার গ্রহণ, দলিল রেজিস্ট্রি, মালিকানা হস্তান্তর, খণ্ড জমি বরাদ্দ, নকশার ছাড়পত্র ও আবাসিক ঋণের ছাড়পত্র পেতেও মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়। রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর সেলের পাশিপাশি এমআইএম শাখায় ফাইল যাওয়ার পর আরেক দফা ভোগান্তি শুরু হয়। সেখানেও নির্ধারিত ঘুষ না দিলে মাসের পর মাস ঘুরেও কোনো কূলকিনারা পাওয়া যায় না। সব মিলিয়ে রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকার বাসিন্দা আর প্লট বরাদ্দ পাওয়া মানুষের কাছে ‘পূর্বাচল সেল’ এক আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজউকের নতুন শহর প্রকল্পের অফিস মূল ভবন থেকে আলাদা করা হয়েছে এনেক্স ভবনে। সেখানে বড় কর্মকর্তাদের যাতায়াত কম। এ সেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীর চেয়ে দালালের সংখ্যাই বেশি। অফিসের এস্টেট শাখার পরিচালক, উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক, কাননগো, এস্টেট তত্ত্বাবধায়ক, ডিলিং অ্যাসিস্ট্যান্ট মিলে এক অপ্রতিরোধ্য সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এ সিন্ডিকেটের বাইরে কারও কিছু বলার নেই। অনুসন্ধানে জানা যায়, সহকারী পরিচালক সদরুল আলম ও মেহেদউজ্জামান, অফিস সহকারী নাছির, হুসেন বাবু, খোকন, জহিরুল, আলম, জাহাঙ্গীর ওই সিন্ডিকেটের মূল হোতা। তারা সেখানকার চিহ্নিত দালালদেরও নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ব্যাপারে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে গতরাতে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্প নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে পূর্বাচল প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে চাই।

সর্বশেষ খবর