বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ফের গোলাগুলি ভারত-পাকিস্তান

প্রতিদিন ডেস্ক

কাশ্মীর সীমান্তে আবারও পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে গুলিবিনিময়ের খবর পাওয়া গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দাবি করছে, গতকাল ভোর ৪টার দিকে বাঘসার ও সামাহনি সেক্টরে ভারতীয় সেনারা গুলি ছোড়ে। জবাবে পাকিস্তানও গুলি ছুড়েছে।

অন্যদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী বলছে, গতকাল সকালের দিকে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের নওসেরা সেক্টরের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গুলি ছুড়েছে পাকিস্তানি সেনারা। জবাবে ভারতীয় সেনারাও গোলাগুলি শুরু করে। সর্বশেষ খবর পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে গোলাবর্ষণ চলছিল। খবর বিবিসির।

অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করে সীমান্তরেখা-সংলগ্ন জনবসতি এলাকা ও সেনাক্যাম্প লক্ষ্য করে ফের মর্টার হামলা ও গুলি চালিয়েছে পাকিস্তান—এমনটাই অভিযোগ করেছে ভারত। ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে দুই দেশের মধ্যবর্তী সীমান্ত লাইন অব কন্ট্রোলের (এলওসি) নওসেরা সেক্টরে এ হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি ভারতের। ভারতের প্রতিরক্ষা মুখপাত্র কর্নেল মনীষ মেহতা বলেন, ‘রাজৌরি জেলার নওসেরা সেক্টরে গতকাল ভোর ৫টা থেকে টানা এক ঘণ্টা ধরে পাকিস্তান হামলা চালায়। সেনাক্যাম্প ও সংলগ্ন জনবসতি অঞ্চল লক্ষ্য করে মর্টার, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, ছোট অস্ত্র দিয়ে গুলি চালায় পাকিস্তান। তবে আমাদের তরফ থেকেও দেওয়া হয়েছে উপযুক্ত জবাব।’ ভারতীয় পুলিশ জানিয়েছে, নওসেরা সেক্টরের কালাসিয়ায় ভারতীয় সেনাদের অবস্থান লক্ষ্য করে পাকিস্তান ১২০ এমএম এবং ৮২ এমএম মর্টারের গোলা ছোড়ে। পাকিস্তানের ছোড়া মর্টারের আঘাতে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পে থাকা একটি পেট্রলপাম্পে আগুন লেগে বিপুলসংখ্যক দোকান পুড়ে যায়। ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের খবরে বলা হয়, এ হামলার ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে সোমবার পাকিস্তানি সেনারা অন্তত চারবার যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে হামলা চালিয়েছে। তারা ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলার সৌজিয়ান, শাহপরু-কেরনি, মান্দি ও কেজিতে এসব হামলা চালায়। এ সময় পাঁচ নারীসহ ১০ জন আহত হন। তবে গতকালের গুলিবিনিময়ের ঘটনায় এখনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে পাকিস্তানে ভারত যে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানোর দাবি করেছে, এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে রাশিয়া। বেসরকারি এক টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্দার কাদাকিন বলেন,"প্রতিটি দেশেরই নিজেকে নিরাপদ রাখার অধিকার রয়েছে।

জলযান আটকের দাবি ভারতের : ভারতের গুরুদাসপুরের রাভি নদী থেকে পাকিস্তানের নৌকা আটক করেছে বলে দাবি করেছে বিএসএফ। বিএসএফের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল কে এস কাটারিয়া বলেন, গতকাল ভোর ৪টা ৪৫ মিনিট নাগাদ রাভি নদীর টোটাবাজ এলাকায় ওই নৌকাটিকে ভাসতে দেখেন তারা। তারপর বিএসএফের টহলদারি নৌকা গিয়ে ওই নৌকাটিকে আটক করে। ওই সময় শুধু একটি কাঠের হাল ও একটি নাইলনের দড়ি পাওয়া গেছে। নৌকাটি ওখানে কীভাবে পৌঁছল তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখন টানাপড়েন চলছে তখন গুরুদাসপুরের রাভি নদী থেকে পাক নৌকা উদ্ধারের ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

ছবি প্রকাশের দাবি কেজরিওয়ালের : সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে একটি ভিডিওবার্তায় আম আদমি পার্টির প্রধান ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল সেনা অভিযানের প্রমাণ চেয়ে ছবি প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। মোদি সরকারের প্রতি তিন মিনিটের ভিডিওবার্তায় কেজরিওয়াল বলেন, ‘পত্রিকায় দেখলাম যে পাকিস্তান বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সীমান্তে পরিদর্শন করাচ্ছে। পাকিস্তান সরকার তাদের বোঝাতে চাইছে যে ভারত সেনা অভিযান বলে যা চালাচ্ছে, এর সব মিথ্যা। এই প্রতিবেদন দেখে আমার রক্ত টগবগ করে ফুটছে। সরকারের উচিত সেনা অভিযানের ছবি সামনে এনে পাকিস্তানের দাবিকে মিথ্যা প্রমাণিত করা।’ কেজরির পথে হেঁটে কংগ্রেস নেতা সঞ্জয় নিরুপমের দাবি, ?যাবতীয় ধোঁয়াশা কাটাতে প্রমাণ প্রকাশ্যে আনুক কেন্দ্র। এদিন টুইট করে নিরুপম বলেন, ‘অভিযানের কোনো প্রমাণ অবশ্যই দেখানো উচিত।’

‘বেটিদের বর্ডার নেই’ : ভারত ও পাকিস্তানের বাতাসে যতই বিষ থাক, যতই চড়ে থাক উত্তেজনার পারদ, যতই থমথমে হোক পড়শি দুই দেশের সম্পর্ক, তার ‘সুষমা’য় কোনো কমতি যে থাকে না, তা ফের বুঝিয়ে দিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সেই ‘সুষমা’রই দেখা মিলল এবার। ভারতে আটকে পড়া পাকিস্তানের ১৯ জন তরুণীকে ইসলামাবাদে ফেরত পাঠাতে সুষমা যেন ত্রাতা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা টুইট বার্তায় লিখলেন, ‘তোমরা মেয়েরা, তোমাদের জন্য কোনো সীমান্ত নেই। তোমাদের জন্য কোনো সীমান্ত থাকে না। তোমরা যাতে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পার, তা আমি দেখছি। তোমরা মা-বাবাকে জানিয়ে দাও, নিশ্চিন্তে থাকো, আমরা ফিরে আসছি।’ ২৭ সেপ্টেম্বর চণ্ডীগড়ে ‘বিশ্ব যুব শান্তি উৎসবে’ অংশ নিতে ইসলামাবাদ থেকে এসেছিলেন এই পাক তরুণীরা। মঙ্গলবার তাদের ঘরে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেছে উরির হামলা। তারপর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। সীমান্তে গোলাবর্ষণ। পাল্টা গুলিবৃষ্টি। ফলে পাক তরুণীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। এ অবস্থায় ১ অক্টোবর পাক পিস ফোরাম ‘আঘাঝে দোস্তি’র আহ্বায়ক আলিয়া হারির দেখা করেছিলেন সুষমা স্বরাজের সঙ্গে। আরও ১৮ জন পাক তরুণীর সঙ্গে আলিয়া নিজেও চণ্ডীগড়ে এসেছিলেন বিশ্ব যুব শান্তি উৎসবে যোগ দিতে। তাদের সমস্যার কথা সবিস্তারে জানিয়েছিলেন সুষমাকে। এর জবাব কাল টুইট করে দিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা।

কাশ্মীরে জড়াবে না যুক্তরাষ্ট্র : কাশ্মীর ইস্যুতে ফের ভারতের পাশে এসে দাঁড়াল আমেরিকা। গত তিন সপ্তাহে এ নিয়ে তৃতীয়বার। বুঝিয়ে দিল, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ যতই একে-ওকে ডাকতে চান না কেন, আমেরিকা তাতে কিছুতেই নাক গলাতে চায় না। আমেরিকা চায়, কোনো তৃতীয় পক্ষ নয়, কাশ্মীর সমস্যা মেটাতে ভারত আর পাকিস্তানই শুধু আলোচনার টেবিলে বসুক। আর কামানের গোলায় জিইয়ে না রেখে কাশ্মীর সমস্যাটা আলোচনার টেবিলে বসেই মিটিয়ে নিক দুই প্রতিবেশী দেশ। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এলিজাবেথ ট্রুডু গতকাল বলেন, ‘কাশ্মীর নিয়ে আমরা আগেও যা বলেছি, এখনো তা-ই বলছি। আমাদের অবস্থান একটুও বদলায়নি। আমরা মনে করি এবং আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করি, কাশ্মীর একটি দ্বিপক্ষীয় ইস্যু। এটি ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এটি একমাত্র দুটি দেশই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মেটাতে পারে। উপমহাদেশে সামপ্রতিক অস্থিরতা কমাতে আমরা ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের সঙ্গেই আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি আলাদা আলাদাভাবে। ভারতীয় উপমহাদেশে অস্থিরতা কমাতে দুটি দেশ যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা তা-ই মেনে নেব। সেটিকেই সমর্থন করব। দুটি দেশের সঙ্গেই আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। আর আমরা তা ধরে রাখতে চাই।’

সমঝোতার সুর : উরি হামলা ও এরপর নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতের প্রত্যাঘাতে দুই সপ্তাহ ধরে কার্যত চরমসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। এর জেরে দুই দেশের সীমান্তে বাড়ছিল সেনা সমাবেশ। উঁকি দিয়েছিল যুদ্ধের আশঙ্কা। কাশ্মীরের পুঞ্চ সেক্টরে নিয়ন্ত্রণরেখায় গতকালও দুই পক্ষের গুলির লড়াই চলেছে। তবে এই উত্তেজনার মধ্যে হঠাৎ শান্তির বার্তা। পাক প্রধানমন্ত্রীর বিদেশনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ দাবি করেছেন, ‘পরিস্থিতির অবনতি রুখতে দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ও নাসির জনজুয়া টেলিফোনে কথা বলেছেন।

উরির ঘটনার পর এই প্রথম দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হলো। উভয় পক্ষই সীমান্তে উত্তেজনা কমাতে রাজি হয়েছে।’ তবে ওই কথা কবে হয়েছে বা এ জন্য কে প্রথম উদ্যোগী হয়েছে, সে বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি তিনি। পাক কূটনীতিকের দাবি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চায়নি নয়াদিল্লিও। যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পরশু শান্তির বার্তা দেওয়ার পর গতকাল সরতাজের ওই বয়ান যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন কূটনীতিকরা। তাদের মতে, যুদ্ধ যে সমস্যার সমাধান নয়, দুই পক্ষই তা জানে। তাই চোখরাঙানির পর এবার স্থিতাবস্থায় ফিরতে চাইছে দুই দেশ। অবশ্য ভারতকে খোঁচা দিতেও ছাড়েননি সারতাজ। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণরেখায় উত্তেজনা কমাতে চায়। কেননা আমরা শুধু কাশ্মীর নিয়ে আগ্রহী। ভারতই সীমান্তে উত্তেজনা বাড়িয়ে কাশ্মীর সমস্যা এড়িয়ে যতে চাইছে।’ তবে সরকারিভাবে আজিজের মন্তব্যের কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি দিল্লি। উল্টো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে বলা হয়েছে, বারামুলার মতো হামলা কীভাবে রোখা যায়, তা নিয়েই গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন ডোভাল। পাকিস্তানের প্রত্যাঘাতের আশঙ্কা মাথায় রেখে সেনাবাহিনীর তিন প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর। তবে সারতাজের দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে সে উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন কূটনীতিকরা। তাদের মতে, দুই পরমাণু শক্তিধর দেশই জানে যুদ্ধ কোনো বিকল্প নয়। এ ছাড়া ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে চাপ বাড়াচ্ছে আমেরিকা। রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশ বা মলদ্বীপের মতো দেশগুলোও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়ার জন্য মুখ খুলতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষই বুঝতে পারছে, যুদ্ধ লাগলে উন্নয়ন, অর্থনীতি ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়বে। সৃষ্টি হবে আর্থিক নৈরাজ্য, যার দায় নিতে হবে সংশ্লিষ্ট সরকারকে। কূটনীতিকরা তাই বলছেন, আস্তিন গোটানোর পালা সাঙ্গ করে এবার হাত ধরা শুরু করুক দুই দেশ। তাতে উভয়েরই লাভ।

সর্বশেষ খবর