শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সাম্রাজ্য নিয়ে এমপি আউয়াল পরিবারে লড়াই

রাহাত খান, বরিশাল

সাম্রাজ্য নিয়ে এমপি আউয়াল পরিবারে লড়াই

জাতীয় সংসদের পিরোজপুর-১ (সদর-নেছারাবাদ-নাজিরপুর) আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য এ কে এম এ আউয়াল। তিনি একটি আসনে এমপি হলেও পিরোজপুর জেলা সদরসহ ৭ উপজেলার একচ্ছত্র অধিপতি। মোগল সাম্রাজ্যের মতো পিরোজপুর জেলার মানুষকে নিজস্ব আইনে শাসন-শোষণ করতেন তিনি। তার সম্মতি ছাড়া আউয়াল সাম্রাজ্যে কোনো কিছুই করার সুযোগ ছিল না কারও। এভাবেই চলছিল গত ৮ বছর। কিন্তু হঠাৎ করে ঝড় উঠেছে সেই সাম্রাজ্যে। লণ্ডভণ্ড হতে শুরু করেছে তার একচ্ছত্র সাম্রাজ্যে। প্রকৃতিই যেন বিরূপ হয়ে প্রবল আক্রোশ নিয়ে হামলে পড়েছে তার ওপর। আপন ভাইদের সঙ্গে সাম্প্রতিক বিরোধে প্রায় এলাকাছাড়া তিনি। পিরোজপুরের অধিপতির এ অবস্থা বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদদৌলার সপরিবারে নৌকায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার কথা মনে করিয়ে দেয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমপি হন এ কে এম এ আউয়াল। জামায়াতের হাই প্রোফাইল নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে হারিয়ে এমপি হওয়ার কৃতিত্বকে কাজে লাগিয়ে দলের মধ্যে একক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন তিনি। সাঈদীকে হারানোর কারণে দলের হাইকমান্ডেরও সুনজর পড়ে এমপি আউয়ালের ওপর। দলের নম্রতার সুযোগ নিয়ে পুরো জেলায় আধিপত্য চালাতে থাকেন তিনি। সবকিছু চলত তার ইচ্ছায়। এমপি আউয়ালের মেজভাই হাবিবুর রহমান মালেক পিরোজপুর সদর পৌরসভার মেয়র। আউয়াল এমপি হওয়ার আগেই ২০০৩ সালে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। আউয়াল এমপি হওয়ার পর সেজভাই মজিবুর রহমান খালেক সদর উপজেলা চেয়ারম্যান হন। ছোটভাই মশিউর রহমান মহারাজ পিরোজপুর বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি এবং চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি। তিন ভাই ছিলেন এমপি আউয়ালের শতভাগ অনুগত। আউয়ালের স্ত্রী লায়লা ইরাদ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এক প্রকার হঠাৎ করেই। এরপর লায়লা ইরাদ ও এমপি আউয়ালের কিশোর ছেলে আবদুর রহমান স্থানীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ শুরু করেন। ইউনাইটেড রয়েল ক্লাব নামে একটি ক্লাব গঠন করে আবদুর রহমান ও এমপিপত্নী কব্জায় নিয়ে নেন জেলার রাজনীতি আর টেন্ডার-নিয়োগসহ সব ব্যবসা-বাণিজ্য। স্কুলের দফতরি, পুলিশ কনস্টেবল থেকে শুরু করে জেলার সব সরকারি দফতরের নিয়োগ পর্যন্ত সবই হতো এমপি পরিবারের প্রেসক্রিপশনে। এ ক্ষেত্রে লেনদেন হতো লাখ লাখ টাকা। টিআর-কাবিখাসহ সরকারের সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচির চাল-গম বরাদ্দেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এমপির বিরুদ্ধে। এমনকি খেয়াঘাটের ইজারা পর্যন্ত ছাড়েনি তার পরিবার। এসব বিষয়ে তাদের প্ররোচিত করতেন এমপির আশপাশে থাকা লোকজন। স্ত্রী-পুত্রের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং অন্যান্য কারণে তিন সহোদরের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় আউয়ালের। ওই দূরত্ব বর্তমানে সংঘাতের পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমনকি মালেক ও আউয়াল একে অপরকে শটগান, পিস্তল নিয়ে হামলা করতে উদ্যত হন। সম্প্রতি ঢাকায় পারিবারিক সমঝোতা বৈঠকে এমপি আউয়াল এবং ছোটভাই মহারাজ বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছিলেন। যা হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে। এ অবস্থায় দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মী তিন ভাইয়ের পক্ষে অবস্থান নেন। এমনকি আউয়ালের ঘনিষ্ঠ নেতা-কর্মীও তার পাশ থেকে সরে ভাইদের কাতারে শামিল হন। তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া তিন ভাইয়ের পক্ষে দিন দিন ভিড় বাড়তে থাকে দলের বঞ্চিত, বিতাড়িত ও নির্যাতিত নেতা-কর্মীর। ওই পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক। আর সার্বক্ষণিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মালেকের স্ত্রী সালমা রহমান হ্যাপী। নিজস্ব বলয় হারিয়ে এবং ভাইদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে এলাকার বাইরে অবস্থান করছেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এমপি আউয়াল। এমপি আউয়ালের সাম্রাজ্যে প্রথম আঘাত হানে ছাত্রলীগ। এমপিপুত্রের পছন্দের সব লোক জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে না থাকায় ওই কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন আউয়াল। তিনি অভিযোগ তোলেন, অছাত্র, শিবিরের অনুপ্রবেশকারী, মাদকাসক্তদের নিয়ে জেলা ছাত্রলীগের কমিটি হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ জেলা ছাত্রলীগের ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সভাপতি শুভ্রজিৎ হালদার বাবু এবং সাধারণ সম্পাদক খাইরুল ইসলাম মিঠুসহ প্রায় সবাই। ছাত্রলীগ জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে সংবাদ সম্মেলন করে আউয়ালের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে।  সাধারণ সম্পাদক খাইরুল ইসলাম মিঠু লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করেন, সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে এমপির নির্দেশ অনুযায়ী দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে নগ্নভাবে কাজ না করায় ছাত্রলীগের ওপর ক্ষুব্ধ হন এমপি আউয়াল। একই সঙ্গে ইউনাইটেড রয়েল ক্লাবের ব্যানারে এমপিপুত্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ করে ছাত্রলীগ। তাদের দাবি এমপিপুত্রকে চাঁদাবাজিতে সহযোগিতা না করায় তাদের ওপর নাখোশ হন আউয়াল।  দলীয় সূত্র জানায়, গত সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ২২ বছর পর জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। এতে সভাপতি হন এমপি আউয়াল। আউয়াল সভাপতি হওয়ার পরও তাকে পাশ কাটিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করতে যান ৭৪ সদস্যের কমিটির সাধারণ সম্পাদকসহ ৫৪ জন নেতা। পৌর মেয়র জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হাবিবুর রহমান মালেক বলেন, ‘এমপি ও তার স্ত্রীর স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, অনিয়মের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে এত দিন মুখ বুজেছিলাম। শুধু দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেই বিচ্ছিন্ন নন, আজ তিনি ও তার পরিবার জনবিচ্ছিন্ন। তার সব অপকর্মের দায়ভার নেবেন না বলেই তারা তিন ভাই জনগণের কাতারে শামিল হয়েছেন। আরেক ভাই সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান খালেক বলেন, ‘এমপি, তার স্ত্রী এবং ছেলের দুঃশাসন জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই উনার (আউয়াল) পাশে নেতা-কর্মী, জনগণ এমনকি ভাইবোন কেউ নেই। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হাকিম হাওলাদার বলেন, আজ এমপি আউয়ালের যে পরিস্থিতি হয়েছে, তার জন্য তিনি নিজেই দায়ী। এত দিন তার একক সিদ্ধান্তে দল চলেছে। ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন কখনো করেননি। ক্ষমতা হাতে পেয়ে অপব্যবহার করলে এর ফল তো ভোগ করতেই হবে। এমপি আউয়াল সেই ফল ভোগ করছেন।

সর্বশেষ খবর