শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা সংকটের শেষ কোথায়

অবৈধ পথে প্রবেশ করছে : বিজিবি, বাংলাদেশে শরণার্থী ঠাঁই দেওয়া কঠিন : জাতিসংঘ
মানবিক দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দুই দেশের আচরণই নিষ্ঠুর : অ্যামনেস্টি

কূটনৈতিক প্রতিবেদক ও কক্সবাজার প্রতিনিধি

রোহিঙ্গা শরণার্থী ঘিরে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বলেছেন, কিছু দালাল টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢোকাচ্ছে। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ করতে মিয়ানমার সরকারকে বলা হয়েছে। যতদিন পারি রোহিঙ্গাদেরকে রাখব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগের দিন বলেছেন, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া কঠিন। কিন্তু একই সময়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ই নিষ্ঠুর আচরণ করছে। সব কিছু মিলিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গা সংকটের শেষ কোথায়। সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী লোকজন বলছেন, মিয়ানমারের সশস্ত্র সেনাসদস্য ও সীমান্তরক্ষীর নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য শত শত রোহিঙ্গা নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে আসছে ১১ নভেম্বর থেকে। গতকাল আরও ১০ পরিবারের অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। এই ১০ পরিবারের ভাগ্যে এখন পর্যন্ত কোনো খাবার জোটেনি। অবশ্য বিজিবি সদস্যরা ৩৪ জন মিয়ানমার নাগরিককে গতকালও ফেরত পাঠিয়েছেন। গতকাল ভোরে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নেওয়া মংডু জামবুনিয়া রাঙ্গাবালি গ্রামের স্বামীহারা বিমর্ষ হতবাক জরিনা খাতুন (৫৫) জানান, রাতের আঁধারে সেনাসদস্যরা অতর্কিত তাদের গ্রামে এসে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে কে কোথায় গেছে তার জানা নেই। তবে নূর ফাতেমা (৭), সাহেনা (৬) ও হাসিনা (৫)সহ তিনজন নাতনি নিয়ে তিনি পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। পরে ঝিম্মংখালী সীমান্ত পথ ধরে এপারে চলে আসেন। তিনি আরও জানান, মোহাম্মদ শাহ আলম (১৭), নূর সালাম (১৫), হামিদ হোছন (১২), আমানউল্লাহ (১০)সহ ৪ ছেলে কোথায় গেছে খোঁজখবর পাননি। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ঘুরে জানা যায়, ১০ পরিবারের অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। মংডু পোয়াখারী নয়াপাড়া থেকে আসা মোহাম্মদ ইউনুছ (২৫) জানান, তারা রাতে ভাত খাওয়ার সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা গ্রামে ঢুকে গুলিবর্ষণ করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় বাড়ির বাইরে এসে দেখা যায়, মানুষ ছোটাছুটি করে পালাচ্ছে। তিনি ও তার স্ত্রী তসলিমা (২২) দুই সন্তান মোহাম্মদ ইদ্রিস (৪) ও হাবিবা (৩)-কে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ধান ক্ষেতে লুকিয়ে পড়েন। পরদিন রাতের আঁধারে টেকনাফ উপজেলার নয়াপাড়া ঘাট দিয়ে এদেশে চলে আসেন। তিনি জানান, নাফ নদ পার হওয়ার সময় নৌকাওয়ালা জনপ্রতি ত্রিশ হাজার (কিয়াত) ভাড়া আদায় করেছে। মিয়ানমারের মংডু খেয়ারীপাড়া গ্রামের বয়োবৃদ্ধ আলি আহমদ (৬০) জানান, তাদের পাড়াটি জ্বালিয়ে দেওয়ায় তারা পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেও সেনাবাহিনী বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে গ্রামটি জ্বালিয়ে দিলে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও তার পরিবারের সাত সদস্যের কোনো খোঁজখবর পাননি। একই এলাকার আবদুল হামিদ (২৬) জানান, সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বিজিপির সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরুষদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর নারীদের ধর্ষণ করছে। তিনি প্রাণ বাঁচাতে কোনো রকমে হেঁটে হোয়াইক্যং সীমান্ত দিয়ে এপারে চলে এসেছেন। তবে তার পরিবারের ছোট ছেলেমেয়েসহ তার স্ত্রী ছেনুয়ারা কোথায় কীভাবে দিন কাটাচ্ছে তার জানা নেই। উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আবুল খায়ের জানান, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পে ঢুকতে না পারে সে জন্য ক্যাম্পের বাইরে সার্বক্ষণিক পুলিশের সতর্ক নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে— স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক কলেজের একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, যারা এরই মধ্যে শরণার্থী হয়ে এসেছেন তাদের আমরা সহযোগিতা করব ফিরে যেতে। আর যাই হোক তারা তো মানুষ। আমরা যত দিন পারি তাদের রাখব। একই সঙ্গে তাদের প্রতি মানবিক আচরণ দেখানো হবে। তারপর তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা মিয়ানমারকে অনুরোধ জানাব। তারা নিশ্চয়ই এটার ব্যবস্থা করবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে মিয়ানমার সরকারকে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাজ করছেন। ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ডেকে নিয়ে এ সমস্যার কথা জানিয়েছেন এবং তিনি মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। এর ফলে এ অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে।

কিছু দালাল টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ঢোকাচ্ছে— বিজিবি মহাপরিচালক : বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজার গিয়ে স্থলপথে উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত এবং গতকাল সকালে তিনটি স্পিডবোটযোগে নাফ নদ দিয়ে টেকনাফ থেকে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখেন। পরে বিকালে তিনি সড়কপথে কক্সবাজারের উদ্দেশে টেকনাফ ত্যাগ করেন। টেকনাফ ত্যাগের আগে স্থলবন্দরের ‘মালঞ্চ’ কটেজ প্রাঙ্গণে বিজিবি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বলেন, ‘কিছু রোহিঙ্গা নাফ নদসহ সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। বিজিবির একার পক্ষে ৬৩ কিলোমিটার জলসীমান্তসহ ২৭১ কিলোমিটার জলপথের শতভাগ নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। যেসব স্থলপথে বিজিবি টহল দিতে পারছে না, সেসব পয়েন্ট দিয়ে দালাল চক্র টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢোকাচ্ছে। এটি অস্বীকার করার অবকাশ নেই। কারণ আপনারা জানেন সীমান্তের উভয় পারে কিছু দালাল রয়েছে। তাদের সহযোগিতায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। যেসব পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটছে, সে রকম কয়েকটি পয়েন্ট চিহ্নিত করে ওই পয়েন্টগুলোতে বিজিবির বাড়তি নজরদারি করা হয়েছে। তবে কী পরিমাণ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে, তার পরিসংখ্যান বিজিবির কাছে নেই।’ আবুল হোসেন বলেন, এটি বিশ্বায়নের যুগ। কোনো কিছু গোপন করার সুযোগ নেই। মিয়ানমারে কী হচ্ছে, তা বিশ্ববাসী দেখছে। এরপরও রোহিঙ্গাদের সব মানবিক সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।

দুই দেশই নিষ্ঠুর আচরণ করছে— অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল : আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমষ্টিগতভাবে শাস্তি দিচ্ছে। এ থেকে বাঁচতে নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করলে তাদের পুশব্যাক করছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ মিয়ানমার ও বাংলাদেশ— দুই দেশের আচরণই ‘নিষ্ঠুর’। এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। বিবৃতিতে সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক চম্পা প্যাটেল বলেছেন, বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে অ্যামনেস্টি জানতে পেরেছে, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের হত্যা করছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ চালাচ্ছে। এরই মধ্যে অন্তত দুই হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে আশপাশের গ্রামে, শরণার্থী শিবিরে এবং বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। তারা খাবার, পানি এবং জরুরি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আশ্রয় দেওয়া কঠিন— জাতিসংঘ : জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) প্রধান কর্মকর্তা জন ম্যাককিসিক বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালানোর মাধ্যমে তাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করছে। ৯ সীমান্তরক্ষীকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সামষ্টিকভাবে শাস্তি দিচ্ছে। শরণার্থী সমস্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরের পরিস্থিতি বেশ গুরুতর জানিয়ে ম্যাককিসিক বলেন, কিন্তু এসব রোহিঙ্গার দেশে ফেরার মতো পরিবেশ তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের দেখাশোনার বিষয়ে বাংলাদেশের একটা দায়িত্ব রয়েছে। তাদের জন্য খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। অবশ্য এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে, শরণার্থীদের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুতর কূটনৈতিক ও মানবিক সমস্যা। এখন বাংলাদেশ যদি সীমান্ত খুলেও দেয়, এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য বা ঘোষণা দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের জন্য খুব কঠিন হবে। এতে মিয়ানমারের সরকারকে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা অব্যাহত রাখায় উৎসাহিত করা হবে। একই সঙ্গে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য, অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধনের বিষয়টিতেও উৎসাহ দেওয়া হবে। আশ্রয়দাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি সদয় আচরণ করছে। কিন্তু তাদের নিজেদেরই সম্পদ সীমিত। বাংলাদেশ সরকারও যে ব্যাপক সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করছে না, সে বিষয়টিকে আমরা স্বাগত জানাই।

সর্বশেষ খবর