শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
পজেটিভ বাংলাদেশ

কুমিল্লার খাদি বাঙালির চিরন্তন সংস্কৃতি

মহিউদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা

কুমিল্লার খাদি বাঙালির চিরন্তন সংস্কৃতি

কুমিল্লার খাদি কাপড়ের বর্ণিল ডিজাইনে মুগ্ধ ক্রেতারা। এ কাপড়   এক সময় সংগ্রামী মানুষ আর গরিবের পোশাক হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন তা ফ্যাশনে সময়ের চাহিদা মেটাচ্ছে। ঈদ-পূজায় খাদির কাপড় ক্রয়ে আগ্রহী হচ্ছেন মানুষ। কুমিল্লার খাদি কাপড়ের দোকানে প্রতিদিনই ক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে। খাদি ব্যবসায়ীদের সূত্র জানায়, খাদির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতবর্ষের স্বাধিকার আন্দোলন ও বাঙালি ঐতিহ্য। এ কাপড় খাদে (গর্তে) বসে তৈরি করা হয় বলে এর নাম দেওয়া হয় ‘খাদি’। কুমিল্লার খাদিপণ্য বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য আর চেতনাকে লালন করছে শতবর্ষ ধরে। শতবর্ষের ঐতিহ্যের খাদি আলোচনায় আসে ১৯২১ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়। তখন মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে সমগ্র ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কুমিল্লায় খাদি শিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সে সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করার জন্য ডাক ওঠে। সর্বত্র এক আওয়াজ ‘মোটা কাপড়-মোটা ভাত’। সেই মোটা কাপড় এখন মিহি হয়েছে। কাপড়ে লেগেছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। কুমিল্লার খাদি শৈল্পিকতার ছোঁয়ায় দেশ-বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। খাদির কাপড় যাচ্ছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে। এ সুনাম অর্জিত হয়েছে কারিগর আর ব্যবসায়ীর অক্লান্ত পরিশ্রমে। খাদি কাপড়ের সঙ্গে কয়েকটি দিক জড়িত রয়েছে। তা হচ্ছে তাঁতি, সুতা কাটুনি, ব্লক কাটার ও রঙের কারিগর। সবাই মিলে তৈরি করেন নান্দনিক খাদি কাপড়। জেলায় দেড় হাজার পরিবার এ পেশায় জড়িত। মহানগরে খাদি কাপড়ের দোকান রয়েছে শতাধিক। ১৯৫২ সালে সমবায় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ড. আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় কুমিল্লার অভয়াশ্রমে দি খাদি অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। মহানগরের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের ‘অভয় আশ্রম’ কর্মীদের প্রচেষ্টায় কুমিল্লার আশপাশের গ্রামগুলোতে হাতে সুতাকাটা ও হস্তচালিত তাঁতের ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়। বিশেষ করে চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া, দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা, সাইতলা, বাখরাবাদ, বেলাশ্বর, ভানী, হারং, গুনঞ্জর, দাউদকান্দির গৌরীপুর, মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুর, রামকৃষ্ণপুর, ঘোড়াশাল, ময়নামতি, জালালপুর, মইনপুর এলাকায় হস্তচালিত তাঁতশিল্পের প্রসার ঘটে। তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে বারেরা, রামচন্দ্রপুর, জাফরাবাদ, সাইকট, বাবিরচড়, কুটুম্বপুর, কলাগাঁও, সোনাপুর, সাইতলা, ভানী, ফুলতলী, দোবাইরা, গণিপুর ইত্যাদি গ্রামগুলোতে মানুষ হাতে সুতা কাটার পেশায় জড়িয়ে পড়ে। খাদিশিল্পের প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন মহানগরের খাদি ঘরের মোহন রাহা, খাদি কুটির শিল্পের শঙ্কর সাহা, খাদি ভবনের দীনেশ দাশ, বিশুদ্ধ খদ্দরের মনমোহন দত্ত ও রাম নারায়ণ স্টোরের কৃষ্ণ সাহা। কুমিল্লার খাদি পোশাকের মধ্যে পাঞ্জাবি, ফতুয়া, সালোয়ার-কামিজ, ওড়না, বিছানার চাদর, গায়ের চাদরসহ ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রীতে নজরকাড়া ডিজাইন আনা হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদির সব ধরনের পোশাকে আধুনিকতা এলেও খদ্দরের সেই মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবি এখনো আগের জৌলুস ধরে রেখেছে। খাদির পোশাক যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি পরতে আরামদায়ক। মহানগরীর মনোহরপুর ও লাকসাম রোডে খাদিপণ্য বিক্রির অসংখ্য নতুন দোকান গড়ে উঠেছে। অন্য জেলার লোকজন বেড়াতে এলে স্মারক হিসেবে নিয়ে যান খাদি। কুমিল্লার খাদিপণ্য বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য আর চেতনাকে লালন করছে শতবর্ষ ধরে। চাঁদপুর থেকে খাদির কাপড় কিনতে আসা সংবাদকর্মী মনোয়ার কানন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসা আইনজীবী এইচ এম সিরাজ বলেন, কুমিল্লার খাদির পোশাক যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি পরতে আরামদায়ক এবং দামে সাশ্রয়ী। কুমিল্লায় আসলে পরিবারের সদস্যদের জন্য খাদির কাপড় নিয়ে যাই। দেবিদ্বারের বরকামতা গ্রামের গ্রামীণ খদ্দর ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী রঞ্জিত দেবনাথ জানান, অনেকে তাঁত বন্ধ করে ভিন্ন পেশা ধরেছে। বাপ-দাদার ঐতিহ্যের পেশা হিসেবে এখনো কাপড় বুনছি। তবে সুতা ও তুলার দাম বাড়ায় আমরা বেকায়দায় পড়েছি। নগরীর লাকসাম রোডের খাদি জ্যোস্না স্টোরের তপন পাল বলেন, খাদি শিল্পের প্রসারে মাঠপর্যায়ে প্রান্তিক খাদি শিল্পীদের সঠিকভাবে জরিপ করে সমস্যা জেনে তাদের সংগঠিত করা উচিত। মহানগরীর খাদি কাপড়ের প্রবীণ ব্যবসায়ী খাদি ঘরের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, বর্তমানে খাদিশিল্পে অনেক নতুন নতুন ডিজাইন এসেছে। কুমিল্লার খাদিপণ্য গুণগত মান বজায় রেখে আধুনিকতার সংমিশ্রণে বাজারে চাহিদা ধরে রেখেছে। পৃথিবীর যেখানে বাঙালি কমিউনিটি আছে সেখানে খাদি কাপড়ের প্রসার ঘটছে। বাংলাদেশের বিদেশি দূতাবাসে খাদিসহ দেশীয় পণ্যের প্রদর্শনী করলে পণ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটাবে।

সর্বশেষ খবর