বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আলোচনার প্রস্তুতি রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে

মাহমুদ আজহার

আলোচনার প্রস্তুতি রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসার উদ্যোগ নিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। নির্বাচন কমিশন নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠনে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের মতামত নেবেন তিনি। এ জন্য ১৮ ডিসেম্বরের পর রাষ্ট্রপতি যে কোনো দিন চা-চক্রের আয়োজন করতে পারেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে। গতকাল বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল বঙ্গভবনে গেলে তাদেরও এমন ইঙ্গিতই দেওয়া হয়। এই সংলাপের উদ্যোগের সফলতা কামনা করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। 

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। এর মাধ্যমে পরবর্তীতে আলাপ-আলোচনার দুয়ার খুলে যেতে পারে। এক্ষেত্রে জরুরি হলো, কার্যকর সংলাপের, যাতে এই আলোচনার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন হয়। সুষ্ঠু নির্বাচনে ওই কমিশন প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে।  সূত্রে জানা যায়, বিজয় দিবসের পরপরই রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে বর্তমান কমিশন ও নিবন্ধিত দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসতে পারেন। বঙ্গভবনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ১৮ ডিসেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করার কথা ভাবা হচ্ছে। আর প্রথম দিনই বিএনপিকে ডাকা হতে পারে। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ পূর্তি হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। এরপর যে কমিশন দায়িত্ব  নেবে, তাদের অধীনেই ২০১৯ সালে একাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে। নতুন কমিশন বাছাই কমিটির মাধ্যমে করা হবে- এমন আভাস আগেই দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি জানান, এবারও আগের প্রক্রিয়ায় ইসি নিয়োগ হবে। ২০১২ সালে যেভাবে বর্তমান ইসি গঠন করা হয়েছিল, এবারও সেভাবেই হবে। এ প্রসঙ্গে প্রবীণ আইনজীবী ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি যদি সংলাপের উদ্যোগ নেন, নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো উদ্যোগ। আমাদেরও যদি রাষ্ট্রপতি আলোচনায় ডাকেন, আমরা মতামত দেব। তবে সার্থক বা সফল তখনই বলা যাবে, আলোচনা যদি অর্থবহ বা কার্যকর হয়।’ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি যদি স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপে বসেন, তাকে ইতিবাচক মনে করি। সবার মতামতের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন হলে সুষ্ঠু নির্বাচনও হবে। এতে গণতন্ত্র বিজয়ী হবে বলে আমি মনে করি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সার্চ কমিটি গঠন নিয়ে অতীতে মরহুম রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে  রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ ফলপ্রসূ হয়নি। তবে এবার যে হবে না, তা তো বলা যাবে না। আমরা বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই।’ ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে নামের সুপারিশ তৈরি করতে চার সদস্যের সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি গঠন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। ইসি গঠন নিয়ে ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ ২৩টি দলের মতামত নেন রাষ্ট্রপতি। এ সংলাপে অধিকাংশ দলই সংবিধান অনুসারে সিইসি ও ইসি নিয়োগে আলাদা আইন করা বা অনুসন্ধন কমিটির পক্ষে মত দেয়। যদিও সার্চ কমিটি গঠন ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল। তাদের অভিযোগ ছিল, শুধু ক্ষমতাসীনদের মতামতই গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি।

সার্চ কমিটি যেভাবে হয়েছিল : প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারককে সভাপতি করে গঠিত সার্চ কমিটিতে সদস্য হন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশন চেয়ারম্যান। এর আগে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অধিকাংশ দলই সার্চ কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছিল। সার্চ কমিটির আহ্বানে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল নতুন কমিশনের জন্য তাদের পছন্দের ব্যক্তির নামের তালিকা দিলেও বিএনপি দেয়নি। কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে যে সুপারিশ জমা দেয়, তাতে সিইসি ও চার কমিশনার নিয়ে পাঁচ পদের জন্য ১০টি নাম আসে। তার মধ্য থেকেই পাঁচজনকে বেছে নেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির আদেশের পর ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরদিন প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিয়েই তারা যোগ দেন ইসিতে। ২০১১ সালের ২৯ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন হয়। এতে  নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অনধিক চার নির্বাচন কমিশনার নিয়ে সর্বোচ্চ ৫ সদস্যের কমিশন গঠনের বিধান যুক্ত হয়।

খালেদার প্রস্তাবনা নিয়ে বঙ্গভবনে বিএনপি : গতকাল সকালে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার ১৩ দফা প্রস্তাবনা নিয়ে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইনুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। তারা প্রায় ১৫ মিনিট বঙ্গভবনে ছিলেন। এ সময় বিএনপির প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতি চিকিৎসা শেষে ফিরে এসে সংলাপের আয়োজন করবেন। বিএনপি প্রতিনিধি দল যাওয়ার আগেই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাষ্ট্রপতি  মো. আবদুল হামিদ চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে রিজভী আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তরের জন্য দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠন ও শক্তিশালীকরণে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থাপিত ১৩ দফা প্রস্তাবাবলির মুদ্রিত কপি ও দলের মহাসচিব স্বাক্ষরিত একটি আবেদন তার সহকারী সামরিক সচিবের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। তিনি সেটা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি শারীরিক অসুস্থতার কারণে বিদেশে গেছেন। তিনি ১১ ডিসেম্বর  দেশে ফিরে আসবেন। এরপর ধারাবাহিকতাভাবে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা করবেন।’ রুহুল কবির রিজভী আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করি, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে এ দেশের মানুষের  যে আকাঙ্ক্ষা- নির্বাচন কমিশন কেমন হওয়া উচিত, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন কমিশন গঠনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।’ রুহুল আলম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের আতিথেয়তা ছিল খুবই আন্তরিক। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি দেশে ফিরলেই কিছু রাষ্ট্রীয় কাজ সেরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবেন। আশা করছি, ডিসেম্বরেই সেটা শুরু হবে। সবার মতামত নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করলে রাজনৈতিক সমস্যা অনেকাংশে সমাধান হবে বলে আমরা মনে করি।’ নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত তার রূপরেখা গত ১৮ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ওই রূপরেখা রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছাতে গত ২১ নভেম্বর খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব আবদুস সাত্তার টেলিফোনে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের সঙ্গে কথা বলেন। কোনো জবাব না পেয়ে ২৩ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ চায় বিএনপি। এতেও সাড়া না পেয়ে প্রস্তাবসহ একটি চিঠি বঙ্গভবনে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নেয় দলটি।

রাষ্ট্রপতিকে ফখরুলের ধন্যবাদ : নির্বাচন কমিশন নিয়ে রাষ্ট্রপতি আলোচনার উদ্যোগ নেবেন জেনে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ উপলক্ষে গতকাল বিকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ ধন্যবাদ জানান। ’৯০-এর ডাকসু নেতৃবৃন্দ ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে। সরকারের উদ্দেশে বক্তব্যে ফখরুল বলেন, এরা স্বৈরাচারকে ছাড়িয়ে পুরোপুরি ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছে। তাই স্বৈরাচারকে পুনর্জীবন দিয়ে ক্ষমতার অংশীদার বানিয়েছে।

ডাকসুর সাবেক ভিপি আমানউল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে ডাকসুর তৎকালীন জিএস খায়রুল কবির খোকন, ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং বর্তমান বিএনপি নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব, ডাকসুর সাবেক এজিএস নাজিম উদ্দিন আলম, সাবেক ছাত্রনেতা মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, খন্দকার লুত্ফর রহমান, সাইফুদ্দিন আহমেদ মণি প্রমুখ বক্তব্য দেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ধ্বংস করবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ অতীতেও তারা গণতন্ত্র হত্যা করেছিল। মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে তা বিশ্বাস করে না। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, গণতন্ত্র ধ্বংস করবেন না। সেই খাতায় নাম লেখাবেন না, যেখানে ধিকৃতদের নাম জনগণের খাতায় লেখা থাকে। আমরা বেশি কিছু চাই না। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন দিন। যে নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করতে পারে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। কারণ বর্তমানে যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্বে তারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নয়। গুম হওয়া নেতা-কর্মীদের সম্পর্কে মির্জা ফখরুল বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য মিথ্যা। যারা গুম হয়েছেন তারা আর ফিরে আসবেন না। আওয়ামী লীগ সরকার জেনেবুঝেই তাদের সরিয়ে দিয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, এই নব্য ফ্যাসিস্টদের পরাজিত করতে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত বেগম খালেদা জিয়ার দেওয়া প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি বলেন, জানতে পেরেছি রাষ্ট্রপতি দেশে ফিরে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইসি গঠনে আলাপ-আলোচনা শুরু করবেন। এতে আমরা যেমন খুশি, পাশাপাশি শঙ্কিতও। কারণ বিগত সময়েও রাষ্ট্রপতি সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগের প্রেসক্রিপশনেই ইসি গঠন করেছিলেন।

সর্বশেষ খবর