বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন

দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোটাররা ব্যক্তি না মার্কা

রোমান চৌধুরী সুমন ও এম এ শাহীন, নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে (নাসিক) প্রতীক ও ব্যক্তি নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন প্রায় ৪ লাখ ভোটার। মেয়র পদে দুই হেভিওয়েট প্রার্থী আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভীর নৌকা ও বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের প্রতীক ধানের শীষ। সবকিছু ঠিক থাকলে লড়াই জমবে এই দুই দলে। তবে মার্কা দেখে ভোট দেবেন ভোটাররা, না ব্যক্তি দেখে ভোট— এ প্রশ্ন এখন নগরজুড়েই।  বিএনপি প্রার্থী প্রচারে নেমে বলছে, নাসিক এলাকায় বিএনপির ৬৫ ভাগ ভোট রয়েছে। প্রার্থীর সঙ্গে একমত দলীয় শীর্ষ স্থানীয় নেতারাও। অন্যদিকে নৌকার প্রার্থী আইভী বলছেন, দলমত নির্বিশেষে ভোটাররা তাকেই ভোট দেবেন। কারণ প্রতীক নৌকার পাশাপাশি রয়েছে তার নিজের উন্নয়নের জোয়ার। এ দুটোই কাজে লাগাবেন তিনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সিটি নির্বাচন হলেও এটি আবহ তৈরি করেছে জাতীয় নির্বাচনেরই। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় ক্ষমতাসীন দলের সাফল্য ব্যর্থতার অগ্নিপরীক্ষা হচ্ছে এ নির্বাচনে। আবার বিরোধী দলের বিগত সময়ের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নও করছেন ভোটাররা। ব্যক্তি দেখে ভোট দিলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এগিয়ে থাকবেন বলে অনেক ভোটার মনে করেন। তবে  ভোটারদের মধ্যে আকর্ষণ করছে দলীয় প্রতীকও। সেক্ষেত্রে ভোটারদের বড় একটি অংশ এও বলছেন, সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়ী হবে। দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কথাও বলছেন কেউ কেউ।  সরকারি তোলারাম কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি সুশীল সমাজের নেতা জীবনকান্তি মোদক জানান, “স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যক্তিকে সাধারণত জনগণ বেছে নেয়। কিন্তু এবার যেহেতু প্রতীকে নির্বাচন, সেক্ষেত্রে  ভোটারদের মধ্যে প্রতীকের ‘ইমোশন’ কাজ করবে, এটা স্বাভাবিক।” ভোটের হিসাবে দেখা যায়, নাসিকের ৩টি থানা এলাকায় রয়েছে বিএনপির সাবেক দুই এমপি আবুল কালাম ও গিয়াসউদ্দিনের ভোটব্যাংক। একই সঙ্গে রয়েছে জামায়াতের প্রায় ১৫ হাজার ভোটার। সব মিলিয়ে বিএনপির ভোটব্যাংক রয়েছ অন্তত ৫৫-৬০ ভাগ। নৌকার প্রতীকে আইভী নৌকার প্রার্থী হিসেবে নন, ব্যক্তি আইভীরও একটি ভোটব্যাংক রয়েছে। পাশে আছে নৌকার ভোট। দুটো একসঙ্গে রাখলে নৌকার পাল্লাই ভারী হয়। জেলার আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এলাকায় তাদের ৭০ ভাগ ভোট রয়েছে। নৌকাই তাদের ভোট প্রাপ্তির প্রতীক। তবে প্রার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ দেখা গেছে বিভিন্ন স্থানে দেওয়া তাদের বক্তব্যে। গত সোমবার প্রতীক বরাদ্দ শেষে নৌকার প্রার্থী আইভী সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, দলমত নির্বিশেষ আমাকে জনগণ ভোট দেবে।  অপরদিকে একই দিনে বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত সাংবাদিকদের বলেন, ‘ধানের শীষ গণতন্ত্রের প্রতীক, নৌকা গণতন্ত্র হরণের প্রতীক। ধানের শীষ দেখেই ভোটাররা তাকে ভোট দেবে। বিএনপির প্রার্থী প্রতীকের দিকে ভোটারদের আকর্ষণ করলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী আইভীর মধ্যে নৌকা ছাড়া দলমত নির্বিশেষে ভোট প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করেছেন।’ এ নিয়ে শহরের চাষাড়া এলাকার ভোটার দোকানি আলমগীর জানান, ‘প্রার্থীদের ব্যক্তি ইমেজ এবং মার্কা সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। অবশ্য আমি কোনো না কোন দলের সমর্থক। অপেক্ষা করছি কাকে ভোট দেব।’ প্রতীক না ব্যক্তি প্রশ্নে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে আমাদের আওয়ামী লীগের ৭০ ভাগ ভোট রয়েছে। নৌকার জোয়ারে ভেসে যাবে প্রতিদ্বন্দ্বীরা। আর বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। যে দুজন ইতিমধ্যে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন।’ এ প্রসঙ্গে জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে আমাদের ৬৫ ভাগ ভোট রয়েছে। বিএনপি ভোটাররা যখন ভোট প্রয়োগ করবেন অবশ্যই তাদের ভিতর প্রতীকের ইমেজ কাজ করবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ সিদ্ধিরগঞ্জের সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘নাসিকের মধ্যে পড়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা। সেখানে আমি ২০০১ সালে নির্বাচিত হয়েছি। এখানে বিএনপি ও আমার বিশাল ভোটব্যাংক রয়েছে। সব ভোটই আমাদের প্রার্থী পাবেন।’ সাবেক এমপি আবুল কালাম জানান, ‘তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছি। দেড় লাখ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছি। আমাদের ভোটাররা অন্য কোনো প্রার্থীকে ভোট দেবে না।’ শহরের এক জামায়াত নেতা জানান, ‘অবশ্যই নৌকায় ভোট দেব না। জোট যেখানে আছে সেখানেই ভোট দেবে জামায়াতের কর্মী-সমর্থকরা।’

অলিগলিতে চলছে প্রচারণা : প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে জোর নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নেমেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা। অলিগলি, রাজপথে তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন। গতকালও ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ভোটারের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও বিএনপির সাখাওয়াত হোসেন খান গতকাল বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। সাখাওয়াতের সঙ্গে ছিলেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আওয়াল মিন্টু, যুগ্ম-মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকার, সাধারণ সম্পাদক কাজী মনিরুজ্জামান, নগর বিএনপির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম, সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল, সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন, আবুল কালাম ও আতাউর রহমান খান আঙ্গুর, জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মাসুকুল ইসলাম রাজীব, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক জাহিদ হাসান রোজেল প্রমুখ।  আইভী গণসংযোগ করেছেন ৬ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলে তার গণসংযোগ। ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পাঠানটুলী, গোদনাইল, এনায়েতনগর, প্রধান বাজার, আইলপাড়া, চৌধুরীবাড়ী ও তাঁতখানায় প্রচারণা চালান তিনি। এ সময় বাসাবাড়ি থেকে প্রচুর নারী-পুরুষকে রাস্তায় বের হতে দেখা গেছে। আইভীও তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কখনো কখনো হাত নেড়েছেন। আবার কখনো আইভীকে দেখা গেছে নারীদের সঙ্গে আলিঙ্গন করতে। অনেক এলাকায় আগে থেকেই ছিল ফুলের মালা। এ ছাড়া তিনি ৬ নম্বর ওয়ার্ডে কিছু সময় অবস্থান করেন। এ সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নৌকা প্রতীক ও ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানান তাকে। এলাকার বিভিন্ন মোড়ে শত শত নারী ভোটার বিগত সময়ে আইভীর কাজের প্রশংসা করেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও উন্নয়নের দাবি জানান। সকাল সাড়ে ১০টায় ৮ নম্বর ওয়ার্ডের এনায়েতনগরে ফকির হাছান আলীর মাজার জিয়ারত করেন আইভী। তার সঙ্গে ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের নেতারা।  অন্যদিকে বিএনপির মেয়র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান ভোরেই শুরু করেন প্রচারণা। ভোর ৬টার পরই তিনি শহরের খানপুর হাসপাতাল রোড, চাষাঢ়া, খানপুর রেললাইন এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেন। সকাল ৮টায় শহরের ঐতিহ্যবাহী বোস কেবিনে নাস্তা সেরে সাড়ে ৮টায় যান শহরের ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকায়।

ওই সময় এলাকার দোকানপাট বন্ধ থাকলেও পথচারীদের সঙ্গে কথা বলেন সাখাওয়াত। বেলা ১১টায় শহরের ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকায় জেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে থেকে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রচারণায় বের হন সাখাওয়াত। বঙ্গবন্ধু সড়কের ২ নম্বর রেল গেট, গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক মোড়, চাষাঢ়া হয়ে আবারও দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে শেষ হয় প্রচারণা। এ ছাড়া সাখাওয়াত হোসেন খানের পক্ষে গণসংযোগ করেছেন শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। পরে তারা ডিআইটিতে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে সভা করে নাসিকের ২৭ ওয়ার্ডে কাজের বিষয়ে কমিটি গঠন করেন।

অন্য মেয়র প্রার্থীর পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মুফতি মাসুম বিল্লাহ সিদ্ধিরগঞ্জ থানার চৌধুরীবাড়ী, তাঁতখানা, এনায়েতনগর, বউ বাজার, মধুগড়, তালতলা, ফয়েজ মার্কেট, মাতবর বাজার, মাঝপাড়ায় প্রচারণা চালান।কাউন্সিলরদেরও দৌড়ঝাঁপ : প্রতীক পেয়ে মেয়র প্রার্থীদের মতোই উজ্জীবিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা। সেই সঙ্গে খুশি তাদের কর্মী-সমর্থকরাও। সোমবার কাউন্সিলর প্রার্থীরা নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে নাসিক নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রতীক বরাদ্দ পান। এরপর নিজের ছবি ও প্রতীক দিয়ে পোস্টার ছাপানোর কাজ শেষ করে ফেলেন অনেকে। প্রতীক পাওয়ার পর প্রার্থীরা ফিরে আসেন নিজেদের বাড়ি বা অফিসে। এ সময় তাদের অনেক উত্ফুল্ল দেখায়। কর্মী-সমর্থকদের প্রার্থীর নাম ও প্রতীক নিয়ে স্লোগান দিতে দেখা গেছে। অনেকে নিজের অফিস ও বাসায় গিয়ে মিলাদ পড়িয়ে দোয়াও করেছেন। নিজের প্রতীক নিয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনেকে বেরিয়ে পড়েন গণসংযোগে। এ সময় তাদের মুখে ছিল হাসি। হাতটা বাড়িয়ে বুকে বুক মিলিয়ে হাসিমুখে করেন কুশল বিনিময়। এরই ফাঁকে নিজের প্রতীকের কথা স্মরণ করিয়ে ভোট প্রার্থনা করেন এবং দোয়া চান ভোটারদের। নারায়ণগঞ্জ সিটির ২৭ ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টির অবস্থান সিদ্ধিরগঞ্জ, ৮টির সদর ও ৯টির বন্দর থানায়।

সর্বশেষ খবর