বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

মাহবুবুল হক শাকিল আর নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

মাহবুবুল হক শাকিল আর নেই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল আর নেই (ইন্না লিল্লাহি... রাজিউন)। গতকাল দুপুরে রাজধানীর গুলশানের সামদাদো রেস্টুরেন্ট থেকে সাবেক এ ছাত্রলীগ নেতার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ গুলশানের ৩৫ নম্বর সড়কের ২৭ নম্বরের বাড়ির এ রেস্তোরাঁর ম্যানেজারসহ ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৪৭ বছর। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে, বাবা-মাসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বিশেষ সহকারী শাকিলের অকালমৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোক বার্তায় তিনি বলেন, তার মৃত্যুতে জাতি একজন বঙ্গবন্ধু প্রেমিক ও দক্ষ সংগঠককে হারালো। একজন ছাত্রনেতা হিসেবে শাকিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

গতকাল সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় রেস্তোরাঁ থেকে শাকিলের লাশ উদ্ধার করে বারডেম হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে হিমঘরে লাশ রাখা হয়েছে। আজ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে তার প্রথম নামাজে জানাজা হবে। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আরেকবার জানাজা হওয়ার কথা রয়েছে। বিকালে শাকিলের প্রিয় শহর ময়মনসিংহে তার লাশ নিয়ে যাওয়া হবে। বাদ মাগরিব আরেক দফা নামাজে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।

শাকিলের মৃত্যুতে মিডিয়া অঙ্গনসহ সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যুর খবর শুনে আওয়ামী লীগ নেতারা ছাড়াও জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক, মিডিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তা এবং শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও নাগরিকরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান।

আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ সাংবাদিকদের জানান, গত সোমবার রাত ৮টায় শাকিল সামদাদোতে যান। সেখানেই তিনি রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে একটি কক্ষে বিশ্রামে ছিলেন। গতকাল দুপুর ১টা পর্যন্ত তার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে রেস্তোরাঁর লোকজন তাকে ডাকতে যান। কর্মচারীরা কক্ষের মেঝেতে তাকে পড়ে থাকতে দেখেন। রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ পরে তার পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের খবর দেয়।

শাকিলের অসুস্থ হওয়ার খবরটি প্রথম তার ব্যক্তিগত ড্রাইভার হেলালকে জানায় রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ। ড্রাইভার সাংবাদিকদের বলেন, আমাকে হোটেল থেকে দুপুরের দিকে ফোন দিয়ে জানানো হয় স্যার অসুস্থ। তারপর আমি সবাইকে ফোনে খবর দিয়েছিলাম। জানা যায়, শাকিলের অসুস্থতার খবর পেয়ে তার ছোট ভাই বাবু, শ্যালক অমিত এবং স্ত্রী আইনজীবী নিলুফা আনজাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। পরে একে একে শাকিলের রাজনৈতিক সহকর্মী, বন্ধু ও পরিবারের অন্য সদস্যরাও ঘটনাস্থলে আসেন। বিকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রাথমিক পরীক্ষার পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন। রেস্টুরেন্ট সূত্র জানিয়েছে, শাকিল এখানে প্রায় আসতেন। অনেক সময় রাতের খাবার খেয়ে দেরি হলে থেকে যেতেন। বাসায় যেতেন না। মৃত্যুর আগের রাতেও তাই হয়েছিল।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপ-প্রেস সচিবের দায়িত্ব পান তিনি। দুই বছর পর তাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর (মিডিয়া) দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৪ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি অতিরিক্ত সচিব মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর দায়িত্বে ছিলেন। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সেল সিআরই পরিচালনার দায়িত্ব পান শাকিল। তিনি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। নব্বইর ছাত্রগণঅভ্যুত্থান ও পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে উঠা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শাকিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শাকিল ১৯৬৮ সালে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জহুরুল হক ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জেলা পরিষদের বিদায়ী প্রশাসক। মা শিক্ষকতা করেন। শাকিল ব্যক্তিগতভাবে কবিতা ও গল্প লিখতেন। একজন মেধাবী, সজ্জন হিসেবে তার সুনাম ছিল বন্ধুমহলে। পদ্য ও গদ্য সাহিত্যে তার দখল ছিল প্রশংসনীয়। লিখতে ভালোবাসতেন তিনি। গত বছরের একুশে বইমেলায় তার প্রথম কবিতার বই ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’ প্রকাশিত হয়। আর এবারের বইমেলায় প্রকাশ হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মন খারাপের গাড়ি’। অন্বেষা প্রকাশনী তার বই প্রকাশ করত। আগামী বই মেলায় তার একাধিক বই প্রকাশের কথা ছিল। একাধিক বইয়ের পাণ্ডুলিপিও শেষ পর্যায়ে। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশনা উৎসবের তারিখ ঠিক হয়ে আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করা শাকিলের সর্বশেষ স্ট্যাটাসটিও ছিল একটি কবিতা।

মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুর খবর শোনার পর রেস্টুরেন্টে তার দীর্ঘদিনের রাজনীতিক সহকর্মী ও দলীয়  নেতারা উপস্থিত হলে পরিবারের সদস্যরা তাদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তার মৃত্যুর খবর শোনার পর পরই সেখানে উপস্থিত হন, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদিন, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, একেএম এনামুল হক শামীম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন, বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম রহমতউল্লাহসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। এ ছাড়া কবি-সাহিত্যিক, সম্পাদক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে সেখানে উপস্থিত হন ইমিরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, সাহিত্যিক ও কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, চ্যানেল আইয়ের শাইখ সিরাজ, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, একাত্তর টেলিভিশনের মোজাম্মেল বাবু প্রমুখ।

মৃত্যুর মাত্র ১৬ ঘণ্টা আগে মাহবুবুল হক শাকিল তার ফেসবুকে একটি কবিতা স্ট্যাটাস হিসেবে দিয়েছিলেন। এলা, ভালবাসা, তোমার জন্য শিরোনামে কবিতাটি ছিল, ‘কোন এক হেমন্ত রাতে অসাধারণ/সঙ্গম শেষে ক্লান্ত তুমি, পাশ ফিরে শুবে/তৃপ্ত সময় অখণ্ড যতিবিহীন ঘুম দিবে/ তার পাশে ঘুমাবে তুমি আহ্লাদী বিড়ালের মতো/তার শরীরে শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে, মাঝরাতে/তোমাদের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে এক প্রগাঢ় দীর্ঘশ্বাস/ আরো একবার তোমাদের মোথিত চুম্বন দেখবে বলে/ মৃতদের কান্নার কোন শব্দ থাকে না, থাকতে নেই/ নেই কোন ভাষা, কবরের কোন ভাষা নেই/ হতভাগ্য সে মরে যায় অকস্মাৎ বুকে নিয়ে স্মৃতি/ তোমাদের উত্তপ্ত সৃষ্টিমুখর রাতে’।

এ ছাড়া জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, যুবলীগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ, ছাত্রলীগের সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। তারা শোকসন্তপ্ত-পরিবারবর্গের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

মৃত্যুর খবর শুনে বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়েন শাকিলের বাবা-মা : শাকিলের মৃত্যুর খবর শুনে ময়মনসিংহের বাড়িতে বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন তার বাবা-মা। শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাতে শহরের ৩৮ নম্বর বাঘমারার বাসায় ছুটে যান ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন, পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান, জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম, পৌর মেয়র ইকরামুল হক টিটু, মহানগর আ.লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, জেলা নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি আনিসুর রহমান খানসহ প্রশাসন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকজন।

সর্বশেষ খবর