আবারও নিখোঁজ হচ্ছে তরুণরা। বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফিরছে না। কেউ কেউ সেই আগের নিখোঁজ তরুণদের মতোই বাবা-মাকে মুঠোফোনে মেসেজ পাঠিয়ে বলছে, ‘আমি ভালো আছি। আমার জন্য চিন্তা করবেন না’। কেউ আবার কোনো খবরও দিচ্ছে না পরিবারের কাছে। হঠাৎ করে বাসা থেকে বেরিয়েই নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ফের শুরু হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। অভিভাবক মহলও উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত।
খোদ পুলিশের হিসাব মতেই, গত এক সপ্তাহে শুধু রাজধানী থেকেই উধাও হয়ে গেছে ৮ তরুণ। এদের মধ্যে দুজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাকিরাও নামিদামি স্কুল থেকে পাস করা। পুলিশের সন্দেহ, এই নিখোঁজ তরুণদের কয়েকজন গুলশান হামলায় জড়িত ছিল। যাদের ঘটনার পর থেকেই খোঁজ করা হচ্ছিল। পুলিশ তাদের খোঁজে এখন মাঠে নেমেছে। এরই মধ্যে নিখোঁজ তরুণদের জীবন বৃত্তান্ত, ছবি পাঠানো হয়েছে দেশের সবকটি স্থল, সমুদ্র এবং বিমানবন্দরে। ১ ডিসেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত নিখোঁজ আটজনের কেউই দেশের সীমান্ত পার হয়নি এ বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ এ প্রতিবেদককে বলেন, খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না এমন সব তরুণই যে বিপথে চলে গেছে তা হলফ করে বলা যাবে না তদন্তের আগ পর্যন্ত। তবে নিখোঁজ সব সময়ই উদ্বেগের। তাদের খোঁজ করে বের করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সন্তানদের বিষয়ে তাদের অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দিয়ে এসব ঠেকানো সম্ভব নয়। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও উচিত হবে তাদের কোনো ছাত্রছাত্রীর আচরণগত পরিবর্তন হলে বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা। প্রয়োজন হলে অভিভাবকদের উচিত হবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সহায়তা নেওয়া। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, গুলশান হামলার পর নিখোঁজদের একাংশের জঙ্গি তত্পরতায় জড়িত হওয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। থানায় করা জিডি এবং গোয়েন্দাদের মাধ্যমে নিখোঁজদের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। কেউ হয়রানির শিকার হওয়ার সুযোগ নেই। জানা গেছে, গুলশান হামলার পর সারা দেশ থেকে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাগুলো পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে। পুলিশ তখন জানতে পারে, বাসা থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়েই তরুণরা যোগ দিচ্ছে জঙ্গিবাদে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের পর কিছুটা চুপচাপ থাকার পর আবারও আলোচনায় এলো নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ। সর্বশেষ চলতি সপ্তাহে নিখোঁজ দুজন হলো ইমরান ফরহাদ (২০) ও সাঈদ আনোয়ার খান (১৮)। এই দুজনের মধ্যে ইমরান ফরহাদ কেয়ার মেডিকেল কলেজের ছাত্র। সাঈদ বাড়িতে পড়াশোনা করে এ বছর ও-লেভেল পাস করেছে। নিখোঁজ দুজনের পরিবারের পক্ষ থেকে বনানী ও ক্যান্টনমেন্ট থানায় পৃথক দুটি জিডি করা হয়েছে। নিখোঁজ ইমরান ফরহাদের এক ফুফাতো ভাই জানান, ‘ইমরান ফরহাদ মোহাম্মদপুরের কেয়ার মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে পড়ত। পরিবারের সঙ্গে সে মাটিকাটা এলাকার ১৪৫/এ নম্বর বাসায় থাকত। গত ২৯ নভেম্বর সকালে মেডিকেল কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর তারা ক্যান্টনমেন্ট থানায় জিডি করেন।’ তিনি আরও জানান, ‘প্রথমে তারা আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের কাছে ইমরানের খোঁজ করেন। ২ ডিসেম্বর তারা ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। তারা বুঝতে পারছেন না ইমরান আসলে কোথায় গেছে বা তার কী হয়েছে।’ তিনি জানান, ‘ইমরানের বাবা প্রবাসী, নাম আসাদুজ্জামান। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। ইমরানদের পরিবার খুবই ধার্মিক। তবে তারা উগ্রপন্থা পছন্দ করেন না। ইমরান উগ্রপন্থি কোনো ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হতে পারে বলে তারা বিশ্বাস করতে পারছেন না।’ গত সোমবার বিকালে কলাবাগানে যান সাঈদ আনোয়ার খান। তিনি নিজে ক্যারাটে জানতেন। ক্যারাটের একটি অনুষ্ঠানে তিনি কলাবাগানে ছিলেন। সেখান থেকে রাত ১০টার দিকে নিজের বাইসাইকেল নিয়ে বনানীর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এরপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে রাজধানীর একটি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে এ-লেভেল পড়ছিল। পরিবারের সদস্যরা জানান, সে উগ্রপন্থায় যেতে পারে এটা কেউ বিশ্বাস করেন না। সাঈদের বাবা আনোয়ার সাদাত খান বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। আনোয়ার সাদাত খান জিডিতে উল্লেখ করেছেন, তিনি পরিবার নিয়ে বনানীর বি ব্লকের ২১ নম্বর সড়কের একটি বাসায় থাকেন। নিখোঁজ হওয়ার আগে তার ছেলের পরণে কালো প্যান্ট ও কালো জ্যাকেট ছিল। তার উচ্চতা ছয় ফুট। তার মা জেনিফার খান বলেন, আমরা পুরো বিষয়টি র্যাব-পুলিশকে জানিয়েছি। আমাদের প্রত্যাশা আমাদের সন্তান সুস্থভাবে ফিরে আসবে। গত পয়লা ডিসেম্বর বনানী এলাকা থেকে এক দিনে নিখোঁজ হওয়া চার তরুণের মধ্যে সাফায়েত ও পাভেল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থসাউথের ছাত্র। বাকি দুজনের মধ্যে সুজন বনানী এলাকার একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। মেহেদী পুরান ঢাকার একটি ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রীর শো-রুমে চাকরি করত। তারা চারজনই বন্ধু। তাদের বয়স ২২ থেকে ২৫ এর মধ্যে। এ ঘটনায় নিখোঁজ পাভেলের বাবা রাসেল খান বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। পুলিশের ধারণা, তারা জঙ্গি গ্রুপে যোগ দিতে পরিবার ছেড়েছে। জানা গেছে, গত ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর বনানী কাঁচাবাজার এলাকায় নর্দান ইউনিভার্সিটির পাশের একটি রেস্তোরাঁয় সাফায়েত ও পাভেল একসঙ্গে খাবার খায়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় অন্য বন্ধু সুজন। এর কিছুক্ষণ পর তারা একসঙ্গে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর থেকে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনার পর জানা যায়, তাদের সঙ্গে মেহেদী নামে আরও এক বন্ধু নিখোঁজ হয়েছে। চার বন্ধুর মধ্যে মেহেদী হাসান বরিশাল বাবুগঞ্জের বিএম কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করে ছয় মাস আগে ঢাকায় আসে চাকরির জন্য। লক্ষ্মীবাজার র্যাংগস-সনি শোরুমে চাকরি করত। দেহেরগতি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, ছেলেটি ভালো ছিল। সে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। মেহেদীরা দুই ভাই। আমার সন্দেহ তাকে পুলিশ কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা আটক করেছে।এদিকে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরের আল জামিয়াতুল নাফিজিয়া আল ইসলামিয়া মার্কাজ মাদ্রাসার নিখোঁজ ছাত্র নেয়ামতুল্লাহ (১৬) তার মায়ের মুঠোফোনে খুদে বার্তা দিয়েছে। ৩০ নভেম্বর রহস্যজনক নিখোঁজের তিন দিন পর নেয়ামতুল্লাহ তার মা কোহিনূর বেগমের মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে লিখেছে : ‘মা, আমি ভালো আছি। আমার জন্য কোনো চিন্তা করবা না। আমি আল্লাহর পথে চলে গেলাম।’ এর পর থেকেই চরম উদ্বেগে পরিবারটি। সে উপজেলার বাকাল গ্রামের খোরশেদ বেপারির ছেলে। এ ঘটনায় নেয়ামতুল্লাহর মাকে বরিশাল র্যাব-৮ কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এই সাতজন নিখোঁজের আগে আরও একজন চিকিৎসক নিখোঁজ হন।
পুলিশ কিছুই জানে না : এই আট ব্যক্তির নিখোঁজ হওয়ার রহস্য এখনো উদ্ঘাটন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের অবস্থান ও নিখোঁজ হওয়ার রহস্য জানতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পাশাপাশি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, র্যাবসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা একযোগে কাজ করছে। গত ১৯ জুলাই এলিট ফোর্স র্যাব ২৬১ জনের একটি নিখোঁজ তালিকা তৈরি করে। ওই তালিকার অনেকেরই সন্ধান পাওয়ার খবর আসায় এর ঠিক ৫ দিন পর পুনরায় ৬৮ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে। সর্বশেষ গত ৩১ সেপ্টেম্বর নিখোঁজ ৪০ জনের তালিকা প্রকাশ করে পুলিশের বিশেষ শাখা। পুলিশের আইজি এই তালিকা সম্পর্কে বলেন, প্রথমে র্যাব একটি বড় তালিকা করেছিল। তারা প্রথমে অতটা যাচাই-বাছাই করতে পারেনি। পরে স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের (এসবি) সহায়তায় নিখোঁজদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৪০ জনের নতুন একটি তালিকা করেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, এরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে।