শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রত্যাশা বাড়ছে সংলাপে

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় ৮ দলের ৭১ দফা প্রস্তাব

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

রাজনীতিতে যখন আলাপ-আলোচনার দুয়ার রুদ্ধ, তখন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সংলাপ নিয়ে প্রত্যাশা বাড়ছে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে এ পর্যন্ত সংলাপে যাওয়া সব রাজনৈতিক দলই এ নিয়ে আশাবাদী। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরাও সংলাপকে দেখছেন ইতিবাচকভাবে। সংশ্লিষ্ট সবার প্রত্যাশা, রাষ্ট্রপতির এ সংলাপ হবে কার্যকর ও ফলপ্রসূ। ১৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া সংলাপে এ পর্যন্ত ৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ৭১ দফা।  আরও ৫টি রাজনৈতিক দলকে ডাকা হয়েছে। প্রথমে ডাকা হয় বিএনপিকে। শেষ দিকে অর্থাৎ জানুয়ারির মাঝামাঝিতে ডাকা হতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি এভাবে যে বিভিন্ন দলকে সংলাপে ডেকেছেন, তা আমাদের বিভেদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। এ সংলাপকে ফলপ্রসূ করতে হলে রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। প্রত্যেকেই যদি নিজেদের মতামতে অনড় থাকেন, তাহলে সংলাপ কখনই ফলপ্রসূ হবে না। রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগকে সমঝোতার জায়গায় পৌঁছে দিতে হলে সব পক্ষেরই নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকা জরুরি।’

এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বিএনপি দিয়েছে ১৩ দফা প্রস্তাব। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি দিয়েছে ৫ দফা। এ ছাড়া লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এলডিপি দিয়েছে ১৭ দফা প্রস্তাব। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের ৮ দফা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৭ দফা, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ৮ দফা, ইসলামী ঐক্যজোটের (লতিফ নেজামী) ৮ দফা এবং বিএনএফের ৫ দফা প্রস্তাব রয়েছে। মোট ৮ দল রাজনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছে ৭১টি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি বিদায় নিচ্ছে। তাই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের এ উদ্যোগ নিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। ওই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই হবে আগামী সংসদ নির্বাচন। সংবিধান অনুযায়ী ইসি গঠনের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। তবে এ জন্য আইন প্রণয়নের কথা সংবিধানে লেখা থাকলেও তা এখনো প্রণীত হয়নি। গতবার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ইসি নিয়োগের সুপারিশের জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতিও গতবারের মতো সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নতুন ইসি নিয়োগ দেবেন বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন। গত ১৮ ডিসেম্বর সংলাপ শুরুর পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সার্চ কমিটিতে কাদের কাদের রাখা যায়, সেই প্রস্তাব দিয়েছে। কয়েকটি দল জরুরি ভিত্তিতে ইসি নিয়োগের আইনের প্রস্তাবও  রেখেছে। সংলাপে প্রথম দফায় ১৮ ডিসেম্বর বিএনপিসহ পাঁচটি দলকে আমন্ত্রণ জানায় বঙ্গভবন। দ্বিতীয় দফায় ২০ ডিসেম্বর আরও ছয়টি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিএনপির সঙ্গে প্রথম পর্যায়ে ডাক পায় জাতীয় পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও ওয়ার্কার্স পার্টি।  দ্বিতীয় পর্যায়ে ডাক পাওয়া বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে সংলাপ গত বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। এ দফায় আমন্ত্রণ জানানো জাতীয় পার্টির (জেপি) সঙ্গে ২ জানুয়ারি, তরীকত  ফেডারেশন ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সঙ্গে ৩ জানুয়ারি আলোচনায় বসবেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘কার্যত রাষ্ট্রপতির এ সংলাপকে ফলপ্রসূ করার দায়িত্ব সরকারের। রাষ্ট্রপতি আমাদের ডেকেছেন। আমরা অংশ নিয়েছি। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আমরা কিছু প্রস্তাবনাও দিয়েছি। কিন্তু সংলাপকে অর্থবহ ও কার্যকর করতে হলে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। সবারই প্রত্যাশা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। ওই কমিশন কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণ করবে না— জাতি এটাই দেখতে চায়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছে, তা ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের রচনা করেছে।’ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল মুহম্মদ ফারুক খান (অব.) বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানানোয় আমরা অভিনন্দন জানিয়েছি। এর আগেও ২০১২ সালে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই নির্বাচন কমিশন অন্যান্য যে কোনো নির্বাচন কমিশনের চেয়ে ভালো নির্বাচন উপহার দিয়েছে। পর্যায়ক্রমেই ভালো নির্বাচন আমরা দেখতে পাচ্ছি। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ এবং জেলা পরিষদ নির্বাচন তাদের মধ্যে অন্যতম। আমরা বিশ্বাস করি, সব রাজনৈতিক দলের পরামর্শ শুনে এবং সংবিধানের ভিতর থেকে একটি গ্রহণযোগ্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন উপহার দেবেন রাষ্ট্রপতি। যাদের নেতৃত্বে আগামীতেও সুন্দর নির্বাচন জাতি দেখতে পাবে।’ সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগ অবশ্যই ইতিবাচক। শুরুটা ভালোই হচ্ছে। সংলাপ কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয় কিনা তার জন্য শেষ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সবারই প্রত্যাশা অর্থবহ সংলাপের। এখন আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে।’

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের মতে, ‘সংলাপের আলোচ্য বিষয় কী ছিল তা পরিষ্কার নয়। বিএনপি বলছে, সার্চ কমিটিসহ কয়েকটি প্রস্তাবনা দিয়েছে। জাসদ বলছে, তারা আইনের কথা বলেছেন। আলোচনা সফল হয়েছে, ফলপ্রসূ হয়েছে এটা ছাড়া কিছু বলা হয়নি। আমার মনে হয় এটা হুজুগে একটা এক্সারসাইজ হয়েছে। আমাদের আশপাশে ভারত ব্যতীত সব দেশে নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে আইন রয়েছে। আইনের বাইরে যে নিয়োগটা হয়, তা হয় খেয়ালখুশি মতো।’ শাহদীন মালিক আরও বলেন, ‘সংবিধানে বলা আছে, আইনের বিধান সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি ইসি নিয়োগ দেবেন। এটা কেউ বুঝতে পারে না, আমাদের সব নিয়োগ রাষ্ট্রপতির নামে হয়। বিচারপতিদের নিয়োগ রাষ্ট্রপতি দিয়ে থাকেন। মন্ত্রীদেরও শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি। পাবলিক কমিশন সিলেকশন করে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে লিস্ট পাঠায়। রাষ্ট্রপতির আদেশে সব নিয়োগ হয়। রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন আইন দ্বারা পরিচালিত। এখানে কেউ বুঝতে পারছে না, আইন প্রণয়নের কাজ রাষ্ট্রপতির নয়। মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদ আছে। সেখানে আইন পাস হয়ে এলে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে দরকার হয়। সংলাপটা কী নিয়ে তা-ই সুস্পষ্ট হলো না। অনেকেই আইনের কথা বলেছেন, আবার অনেকেই বলেননি।’

বঙ্গভবনের সংলাপে ডাক আরও পাঁচ দলকে : নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনার জন্য তৃতীয় পর্যায়ে আরও পাঁচটি রাজনৈতিক দল আমন্ত্রণ পেয়েছে। এ দলগুলো হলো— বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), সাম্যবাদী দল, বিকল্পধারা ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। গতকাল এ দলগুলোকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দলগুলোকে তাদের কার্যালয়ের ঠিকানায় চিঠি পাঠানো হয়েছে।’

গত ১৮ ডিসেম্বর বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই সংলাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ডাক এখনো আসেনি। নতুন পাঁচটি দলের আগে দুই দফায় ১১টি দলকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তৃতীয় পর্যায়ে ডাকা দলগুলোর মধ্যে ৪ জানুয়ারি বিকাল ৩টায় ন্যাপের সঙ্গে এবং বিকাল ৪টায় দিলীপ বড়ুয়া নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় সিপিবির সঙ্গে বসবেন রাষ্ট্রপ্রধান। ৭ জানুয়ারি বিকাল ৩টায় বিকল্পধারা এবং বিকাল ৪টায় জেএসডির সঙ্গে আলোচনার সময় নির্ধারিত হয়েছে। বঙ্গভবনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির চলমান আলোচনা আগামী জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলতে পারে। দ্বিতীয় সপ্তাহেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ডাকা হতে পারে।’

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর