শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

শেষ ভালোর তৃপ্তিতে বিদায়ী ইসি

গোলাম রাব্বানী

শেষ ভালোর তৃপ্তিতে বিদায়ী ইসি

নির্বাচন কমিশনে চলছে বিদায়ের প্রস্তুতি। বর্তমান কমিশনের মেয়াদ আছে আর এক মাস কয়েক দিন। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বিদায় নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। ইতিমধ্যে নিজ নিজ ফাইলপত্র গুছানো শুরু করেছেন কমিশনাররা। বিগত পাঁচ বছরে নানামুখী সংকটে ছিল নির্বাচন কমিশন। সরকারের আজ্ঞাবহ,

মেরুদণ্ডহীনসহ নানা গালিও শুনতে হয়েছে ইসিকে। সেই সঙ্গে বিদায়ের আগে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকেও অব্যাহতি পায় বর্তমান ইসি। তবে বছরের শেষ মাসে এসে কিছুটা প্রশংসা কুড়িয়ে বিদায় নিচ্ছেন তারা। বিশেষ করে চলতি বছরের শুরুতে আচরণবিধি লঙ্ঘন, হামলা-সংঘর্ষের মধ্যে প্রথমবার দলীয় প্রতীকে পৌরসভা ভোট শেষ করে। এরপর অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে ইউনিয়ন পরিষদের ভোটও করে নির্বাচন কমিশন। এ সময় দখল-সংঘর্ষ ও শতাধিক প্রাণহানির মধ্যে শেষ হয় দলীয় প্রতীকের ইউপি ভোট। সব মিলে নানা বিতর্কের মুখে বছর শেষ হলেও বিদায়ের আগ মুহূর্তে ডিসেম্বরে এসে সবার সহযোগিতায় দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভোট করে শান্তিপূর্ণভাবে। যা নিয়ে সব মহলে প্রশংসা কুড়ায় ইসি। সেই সঙ্গে এ নির্বাচনকে দৃষ্টান্তমূলক বলে মত দেয় পর্যবেক্ষকরাও। একই সঙ্গে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচনও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন কমিশন। নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, শেষ ভালোর তৃপ্তি নিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারিতে বিদায় নেবে বর্তমান ইসি। বিদায়ের আগে শেষ নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে পেরে নারায়ণগঞ্জ ও জেলা পরিষদের ভোট শেষে প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রথমবারের মতো চার নির্বাচন কমিশনারকে সঙ্গে নিয়েই হাজির হন সিইসি কাজী রকিব। তাদের সবার মুখেও ছিল খুশি ভাব। এ সময় সিইসি নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ভবিষ্যতের জন্য পরামর্শ দেন ‘স্বস্তি’ নিয়ে। নারায়ণগঞ্জে সুষ্ঠু ভোটের জন্য ভোটার ও প্রার্থীদের কৃতিত্ব দেন আর জেলা ভোটের বিষয়ে জানান, সার্বিকভাবে প্রথমবার ‘আলাদা রকমের’ ভোটটি শান্তিপূর্ণ হয়েছে।

পাঁচ বছরে ইসি নানা বিষয়ে বিতর্কের মুখে পড়লেও নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন নিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ বছরের নানা সফলতাও যোগ হয়েছে ইসির ভাণ্ডারে। এরই মধ্যে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করে এবং তাদের কাছে উন্নতমানের স্মার্টকার্ডও বিতরণ করা হয়েছে। দেশজুড়ে ভোটারদের মাঝে স্মার্টকার্ড বিতরণও শুরু হয় এ বছর। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়ার পর রাজধানী থেকে বিতরণ শুরু হয়েছে; আগামী বছরের ডিসেম্বরে তা শেষ হবে সব ভোটারের হাতে দিয়ে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন চালু করতে নতুন করে উদ্ভাবন করে ইসির নিজস্ব ইভিএম। তা কার্যকর করতে করা হয়েছে একটি বিশেষ কারিগরি টিম। মনোনয়নপত্র জমা দিতে প্রথমবার চালু করা হয়েছে অনলাইন পদ্ধতি। অবশ্য জেলা পরিষদের এ সেবা কেউই ব্যবহার করেনি।

২০১২ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন শেষ করেছে বর্তমানের পাঁচ সদস্যের ইসি। তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় নতুন রেকর্ড, হামলা-সংঘর্ষ রোধে ব্যর্থতা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের বেপরোয়া অবস্থা নিয়ে বেশ সমালোচনায় পড়েন তারা। বিএনপি ও শরিকদের বর্জনের পাশাপাশি বাধার মুখে ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচন করতে হয় কমিশনকে। এ পরিস্থিতি সামলে উঠে ২০১৫ সালে ধাপে ধাপে উপজেলা পরিষদের ভোট করতে গিয়ে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হন সিইসিও। ভোটের মাঝখানে দেশের বাইরে চলে যান তিনি। এ বছরের ৩০ ডিসেম্বর শেষ করে দলীয় পৌর ভোট। এ নির্বাচনে এমপিদের আচরণবিধি লঙ্ঘনে ‘দিশাহারা’ হয়ে পড়ে কমিশন। সেক্ষেত্রে কারণ দর্শানো নোটিস ও অভিযোগ তদন্ত, মামলার নির্দেশনা দিয়ে দায় সারেন তারা। অনিয়ম ও নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের জন্য একটি পৌরসভাসহ ১৮টি পৌরসভার ৩৮টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করা হয়। কেন্দ্র দখল, প্রকাশ্যে সিল মারাসহ নানা অনিয়ম দেখে অধিকাংশ দল ও পর্যবেক্ষক মহল কমিশনের ‘সক্ষমতা’ নিয়েও প্রশ্ন তোলে। ফেব্রুয়ারিতে ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ২২ মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত চলে ছয় ধাপের ভোট। এ ছয় ধাপে শতাধিক লোকের প্রাণহানির পাশাপাশি নির্বাচনী অনিয়ম রোধে ইসির ‘দৃঢ়’ ভূমিকা না পেয়ে সব মহলে অসন্তোষ দেখা দেয়। এ সময় শতাধিক ইউপির সাড়ে তিনশ ভোটকেন্দ্র স্থগিত হয়। অক্টোবরে শেষ হয় ইউপির বাকি ভোট। এ নিয়ে কমিশনের সমালোচনায় দল ও পর্যবেক্ষক মহলও বলছে, এটা শুধু প্রশ্নবিদ্ধ ভোট নয়; গুলিবিদ্ধ ভোট।

নভেম্বরে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ইসি। ২২ ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করে ভোট। সেই সঙ্গে জেলা পরিষদ নির্বাচন করে ইতিহাসে প্রবেশের প্রচেষ্টাও চলে। সরকারের ইচ্ছায় ২৮ ডিসেম্বর ভোটের তারিখ রাখে স্থানীয় সরকার বিভাগ। শেষ মুহূর্তে ইসির তাড়াহুড়োয় নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পূর্ণাঙ্গ সময়সূচি জানায় ইসি। এ নির্বাচনে অনলাইন প্রক্রিয়ায় মনোনয়নের সুযোগও দেওয়া হয়। প্রার্থী ভোটারের ইতিবাচক আচরণ, রাজনৈতিক দলগুলোর সব ধরনের সহায়তা, সরকারের সদিচ্ছা ও রিটার্নিং কর্মকর্তার ব্যবস্থাসহ সব মিলিয়ে ইসির দৃঢ়তায় ২২ ডিসেম্বর সুষ্ঠু নির্বাচন হয় নারায়ণগঞ্জে। নানা ধরনের শঙ্কা থাকলেও সব ছাপিয়ে দৃষ্টান্তমূলক ভোট হয়েছে বলে সব মহল বলেছে। আর জেলা পরিষদ ভোট নিয়ে দলগুলোর অনাগ্রহ থাকলেও ক্ষমতাসীনদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। এমপিদের অনেকে আচরণবিধি উপক্ষো করেছেন। এ নিয়ে অনুরোধ সংক্রান্ত চিঠি চালাচালি হলেও কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি ইসি।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে চার সদস্যের সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। ওই কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে যে সুপারিশ জমা দেয়, তাতে সিইসি ও চার কমিশনার নিয়ে পাঁচ পদের জন্য ১০টি নাম আসে। তার মধ্য থেকেই পাঁচজনকে বেছে নেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির আদেশের পর ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পর দিন প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিয়েই তারা যোগ দেন ইসিতে।

 

সর্বশেষ খবর