শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
সালতামামি ২০১৬

বছরজুড়ে আলোচনায় জঙ্গি

আলী আজম

বছরজুড়ে আলোচনায় জঙ্গি

হলি আর্টিজান হোটেলে জঙ্গি হামলা শিরোনাম হয় বিশ্ব গণমাধ্যমে —ফাইল ছবি

বিদায় ২০১৬। বছরজুড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল জিম্মি-হত্যা, হামলাসহ জঙ্গিদের নানা তত্পরতা। আতঙ্কিত ছিল দেশবাসী। উৎকণ্ঠায় ছিল বিদেশিরাও। জঙ্গিদের তত্পরতায় কিছু সময়ের জন্য হলেও থমকে গিয়েছিল জাতি। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর আশকোনার আস্তানায় জঙ্গিদের ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব। তবে জঙ্গিরা যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ঠিক সেভাবেই তাদের দমন করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জঙ্গি দমন অভিযান দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এসব অভিযানে নিহত হয় ৩৭ জঙ্গি এবং এক নারী জঙ্গি সুইসাইড করেন।

জানা গেছে, গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মাধ্যমেই মূলত জঙ্গিরা আগ্রাসী ভূমিকায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। হলি আর্টিজানে জঙ্গিরা দেশি-বিদেশি নিরীহ মানুষদের জিম্মি করে যে বর্বর হত্যাকাণ্ড চালায় তাতে শিউরে ওঠে মানবতা। এ ঘটনায় দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে জঙ্গিরা। দেশকে সমালোচনায় ফেলে দেওয়া এ ঘটনায় অবশ্য চরম আঘাত হেনে জঙ্গিদের দমন করেন পুলিশ-র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

হলি আর্টিজানে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনায় পাঁচজন জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। বেশ কয়েকজন জিম্মিকে উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটি)। অভিযানে এক কিশোর জঙ্গি নিহতসহ সুইসাইড করে এক নারী জঙ্গি। এভাবে একে একে ১১টি জঙ্গি আস্তানা আবিষ্কৃত হয়। এসব আস্তানায় অভিযানে নিহত হয় জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীসহ দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা। কয়েকজন জঙ্গি পুলিশ ও র‍্যাবের কাছে আত্মসমর্পণও করে।

জানা গেছে, গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর ঢাকার কল্যাণপুর, রূপনগর, আজিমপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও দক্ষিণখানে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট ও এলিট ফোর্স র‍্যাব। এসব অভিযানে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের ৩৭ জন সদস্য নিহত হয়। বেশ কয়েকজন জঙ্গি গ্রেফতার হয় এবং সক্রিয় জঙ্গিদের কয়েকজন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। ইতিমধ্যে পুলিশ ও র‍্যাবের জঙ্গি দমনের কৌশল দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ থেকে ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত ৫৮টি জঙ্গি হামলা হয়। পুলিশের অভিযানে নিহত হয় ৫৫ জঙ্গি। এর মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির ৪৫ জন, এবিটির ৮ জন এবং অন্যান্য পাঁচজন। গ্রেফতার করা হয় ২৩৮ জনকে। এসব জঙ্গির কাছ থেকে ৪৭টি পিস্তল, এসএমজি (একে-২২) ৪টি, রাইফেল (একে-২২) ৬টি, গুলি ৯৭১ রাউন্ড, খালি কার্তুজ ১১০৭, ম্যাগাজিন ৫৭টি, হ্যান্ড গ্রেনেড ১১১টি, ককটেল ৪টি, বোম্ব ১৬টি, চাপাতি ৬২টি, বিস্ফোরক পদার্থ ৫০০, মোটরসাইকেল ১১টি, ল্যাপটপ ১০টি, ক্যামেরা ৩টিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। র‍্যাব সদর দফতর সূত্র বলছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ৬২ জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে জেএমবির রয়েছে ৪৭ জন। এসব জঙ্গির কাছ থেকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ১০টি, গোলাবারুদ ৩৩৭ রাউন্ড, গ্রেনেড/বোম্ব/ককটেল ১১১টি, বিপুল পরিমাণ ডেটোনেটর (ইলেকট্রিক/নন-ইলেকট্রিক) ও বিস্ফোরক, সাংগঠনিক বই-সিডি-লিফলেট-পোস্টার-ক্যালেন্ডার ২৩৩টি এবং ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ছয়জন নিহত এবং ছয়জন র‍্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গিদের শক্তি অনেকটাই দুর্বল করে দিয়েছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এখন পলাতক জঙ্গি নেতাদের নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই, অচিরেই তারা ধরা পড়বে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী ভালো কাজ করছে বলেই এরা নিয়ন্ত্রণে আছে। সব সময় আমরা তাদের (জঙ্গি) অনুসরণ করে চলছি এবং তারা (জঙ্গি) যে কোনো সময় ধরা পড়বে। সারা পৃথিবীতেই জঙ্গি আছে। আমাদের এখানে জঙ্গি মাঝে মাঝে আত্মপ্রকাশ করতে চেষ্টা করে। এগুলো সবই নিয়ন্ত্রণে আছে।

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, যারা জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে তারা দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে। অন্যথায় জঙ্গিদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকবে। জঙ্গি নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। নতুন করে কেউ যেন জঙ্গি তত্পরতায় অংশ নিতে না পারে সে জন্য প্রত্যেক পরিবারকে তাদের সন্তানের প্রতি সচেতন হতে হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা সবাইকে থমকে দিয়েছিল। এ সময় জঙ্গি দমনে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট অত্যন্ত সফল কার্যক্রম শুরু করে এবং বেশ কয়েকটি সফল অভিযানের মধ্য দিয়ে জঙ্গিদের দুর্বল করে ফেলেছে। তারা আর সংগঠিত হতে পারবে না। এদেশে জঙ্গিবাদ কখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। জঙ্গিদের অর্থদাতা, উৎসাহদাতা ও সমর্থনদাতা সবাইকে নজরদারিতে রেখেছি।

গুলশানে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ : ১ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে আকস্মিক হামলা চালায় সশস্ত্র জঙ্গিরা। জিম্মি করে দেশি-বিদেশিসহ অর্ধশতাধিক নিরীহ মানুষকে। পুলিশ অভিযান শুরু করলে জঙ্গিদের গ্রেনেড ও গুলিতে নিহত হন ডিএমপির এসি রবিউল হক ও বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন খান। পরে জিম্মিদের নিরাপদে উদ্ধারে নিত্য নতুন কৌশল খুঁজতে থাকেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা।

২ জুলাই সকালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অপারেশনে নামানো হয় সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীকে। সঙ্গে থাকে ডিএমপির বিশেষ প্রশিক্ষিত সোয়াত টিম। জঙ্গি দমনে ও জিম্মিদের উদ্ধারে চালানো হয় ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’। মাত্র ১৩ মিনিটের কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গিসহ ৬ জন। জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ৩৩ জনকে। এ ঘটনায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে জঙ্গিরা।

শোলাকিয়া ঈদগাহ এলাকায় হামলা : ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া মাঠের কাছে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের ওপর বোমা হামলা এবং গুলি চালিয়ে দুই কনস্টেবলসহ তিনজনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয় আবীর রহমান নামে নব্য জেএমবির এক সদস্য। আহত অবস্থায় গ্রেফতার করা হয় শফিউল নামে আরেক জঙ্গিকে। পরে ৫ আগস্ট র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শফিউল ও তার সহযোগী আবু মোকাতিল নামে দুই জঙ্গি নিহত হয়।

কল্যাণপুরে অপারেশন স্টোর্ম-২৬ : ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে জাহাজ বিল্ডিং নামে একটি পুরনো ভবনে জঙ্গি আস্তানা শনাক্ত করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। সেখানে চলে ‘অপারেশন স্টোর্ম-২৬’। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াত টিমের অভিযানে ওই আস্তানায় নিহত হয় ৯ জঙ্গি।

নারায়ণগঞ্জে অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭ : ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার একটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াত। ওই অভিযানে নিহত হয় নব্য জেএমবি শীর্ষ নেতা ও গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহম্মেদ চৌধুরীসহ তার আরও দুই সহযোগী।

রূপনগর আস্তানায় অভিযান : ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রূপনগরের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। অভিযানে নিহত হয় জঙ্গি নেতা ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় অংশগ্রহণকারীদের তিনি গাইবান্ধার চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ দিতেন। নারায়ণগঞ্জে তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর নব্য জেএমবিতে তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা ছিল মেজর (অব.) জাহিদের।

আজিমপুর আস্তানায় অভিযান : ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আজিমপুরের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। সেখানে নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা ও আশ্রয়দাতা তানভীর কাদেরী নিজেই গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মাহুতি দেয়। ঘটনাস্থলে গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাকারী দুই নারীসহ তিন নারী জঙ্গি ও তানভীরের ১৪ বছর বয়সী এক ছেলেকে আটক করা হয়।

গাজীপুরে ‘অপারেশন স্পেট ৮’ : ৮ অক্টোবর গাজীপুরের জয়দেবপুরে জঙ্গি আস্তানায় ‘অপারেশন স্পেট ৮’ অভিযান চালানো হয়। অভিযানে জেএমবির ঢাকা বিভাগের অপারেশন কমান্ডার ফরিদুল ইসলাম ওরফে আকাশ ওরফে প্রভা ওরফে সানোয়ারসহ ৭ জেএমবি সদস্য নিহত হয়। একই দিন জঙ্গিবিরোধী তিনটি অভিযান চালায় র‍্যাব। অভিযানে গাজীপুরের হাড়িনালে দুই জঙ্গি, টাঙ্গাইলে দুই জঙ্গি এবং আশুলিয়ায় নিহত হয় জঙ্গিদের অর্থদাতা সারোয়ার জাহান ওরফে নয়ন। পুলিশ-র‍্যাবের পৃথক অভিযানে একই দিন নিহত হয় ১২ জঙ্গি।

আশকোনায় ‘অপারেশন রিপল-২৪’ : ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এ সময় আত্মসমর্পণ করেন নিহত জঙ্গি নেতা মেজর (অব.) জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা ও তার শিশু কন্যা এবং জঙ্গি নেতা মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা ওরফে তৃষা ও তার পাঁচ বছর বয়সী শিশুকন্যা। অভিযানে কিশোর জঙ্গি আফিফ কাদেরী নিহত হয়। এ ছাড়া আত্মঘাতী গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত হন নারী জঙ্গি শাকিরা ওরফে শাকিলা। এ সময় তার চার বছর বয়সী মেয়ে সাবিনাও মারাত্মক আহত হয়।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর