মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর গাইবান্ধা

জুলকার নাইন

নিরিবিলি ও শান্ত পরিবেশের জেলা গাইবান্ধা হঠাৎ গত কয়েক বছরে হয়ে উঠেছে অশান্ত ও ভয়ঙ্কর। জেলার কমপক্ষে তিনটি উপজেলায় উগ্রবাদীদের তত্পরতা ভাবিয়ে তুলেছে দেশের প্রশাসনকে। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকেই বেরিয়ে আসতে থাকে গাইবান্ধার এ পরিবর্তিত চেহারা। জামায়াতে ইসলামীর ধ্বংসলীলার নানা চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে জেলার বিভিন্ন স্থানে।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পড়েও দেখা গেছে একই চিত্র। ভোটকেন্দ্র হিসেবে স্কুল জ্বালিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে আগুনে পুড়িয়ে অর্ধ ডজন পুলিশ হত্যা এবং অস্ত্র লুটের ঘটনাও ঘটেছে এ জেলায়। পরবর্তীতে হলি আর্টিজানের বীভৎস হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া জঙ্গিদের একটি অংশকে গাইবান্ধার যমুনার চরে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রমাণও পায় গোয়েন্দারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, পলাশবাড়ী, গোবিন্দগঞ্জ ও ফুলছড়ির বিভিন্ন অংশে বেশ আগে থেকেই  স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর তত্পরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এর মধ্যে সুন্দরগঞ্জ ছিল জামায়াতের একচ্ছত্র আধিপত্য। জামায়াতের এমপিও ছিল সেখানে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এ নেটওয়ার্কের ছত্রছায়াতেই উগ্রমতাদর্শ বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। জেলাশহর গাইবান্ধার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তেমন সচ্ছল না হওয়ায় সহজ হয়েছে উগ্রবাদীদের সদস্যসংগ্রহ। অনেকে পরিবারসহ জড়িয়েছে এ ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে। যার সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বাড়িতে ঢুকে ক্ষমতাসীন দলের এমপিকে গুলি করে হত্যার ঘটনা। জানা গেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধী দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। মামলার রায় ঘোষণার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তাণ্ডব শুরু করা হয় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে। জামায়াত-শিবির কর্মীরা সুন্দরগঞ্জে বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ, ঘরবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, থানা-ফাঁড়ি ও পুলিশের ওপর হামলা করে। তারা বামনডাঙ্গা রেল স্টেশন, সুন্দরগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়, কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি ও বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ি, ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়ে দেয় এবং লুট করে। আগুনে পুড়িয়ে ও নির্মমভাবে পিটিয়ে মারা হয় ৪ পুলিশ সদস্যকে। এভাবে পুরো সুন্দরগঞ্জ চলে যায় জামায়াত-শিবিরের দখলে। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে চলে অচলাবস্থা। বেশ কয়েক স্থানে এ সময় রেল লাইনও উপড়ে ফেলা হয়। কয়েকদিনে স্থানীয় প্রায় দেড় শতাধিক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইউএনও অফিস, উপজেলার বেলকা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ভাঙচুর এবং উপজেলা পরিষদ মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের বাস ভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সুন্দরগঞ্জের পাশাপাশি গাইবান্ধার অন্য উপজেলাতেও চলে তাণ্ডব। তারা বড় বড় রামদা নিয়ে টহল দেয় ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে। বিশেষত গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর মহেশপুর, সাদুল্লাপুরের গোসাইজানি ব্রিজ এলাকা এবং গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কের অধিকাংশ এলাকায় অবস্থান নিয়ে সড়কের গাছ কেটে তারা পাহারা বসায়। সে সময়ই সাঘাটা উপজেলায় রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে ৪ যাত্রী এবং সদর উপজেলার তুলসীঘাটে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে নয়জন নিরীহ যাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। গাইবান্ধার বাসিন্দাদের বক্তব্য অনুসারে, এরপর পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাবের মুহুর্মুহু অভিযান ও গ্রেফতারের ফলে আপাতত বন্ধ হয় ধ্বংসলীলা। কিন্তু শুরু হয় চোরাগোপ্তা হামলা ও জঙ্গিবাদী তত্পরতা। গত বছর গোবিন্দগঞ্জে তরুণ দত্ত ও দেবেশ প্রামাণিক নামে দুই ব্যবসায়ীকে গলা কেটে হত্যা করে জঙ্গিরা। সুন্দরগঞ্জের ডোমেরহাটে গলা কেটে ফেলে রাখা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা মামুনকে। গত বছরের জুলাই মাসে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলার আগে জঙ্গিরা গাইবান্ধার দুর্গম চরে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। যমুনা নদীর একটি চরে সাতজনকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল কিছুদিন ধরে। এই প্রশিক্ষণ দিয়েছিল কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গি রায়হান কবির। দুর্গম এই চরগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনবসতি না থাকায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন সহজ হয়েছিল।  জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া এ বিষয়ে বলেন, ২০১৩ সালে বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে চারজন পুলিশসহ ছয়জনকে হত্যা করেছিল জামায়াত-শিবির কর্মীরা। সে মামলার আসামিদের যথাযথ শনাক্ত করে গ্রেফতারের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে পারলে আজ লিটনের হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটত না। গাইবান্ধা সদরের এমপি ও জাতীয় সংসদের হুইপ মাহবুব আরা বেগম গিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে হামলার লক্ষ্যে পরিণত হন সুন্দরগঞ্জের এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন। লিটনের শত্রুই ছিল জামায়াত-শিবির। ছাত্র রাজনীতি যখন করতেন তখন থেকে জামায়াতকে প্রতিহত করে সুন্দরগঞ্জে রাজনীতিতে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। জামায়াতের চক্রান্তের মধ্যেই সংসদ সদস্য পদ ধরে রেখেছিলেন। জামায়াতকে এক ধরনের কোণঠাসা পরিস্থিতিতে রেখেছিলেন তিনি। লিটনের এই মৃত্যুতে কে লাভবান হবে? এতেই তো বোঝা যায়—ঘটনাটা কে বা কারা ঘটিয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসলীলা চালানোর অপচেষ্টা এখনো করেই যাচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর