বুধবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
ওয়ান-ইলেভেন কাহিনী

সেই ১২৩২ কোটি টাকা ফেরত পাননি ব্যবসায়ীরা

হয়রানির শিকার, কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গত ৮ বছরে পাওয়া যায়নি

রুহুল আমিন রাসেল

ব্যাপক দমন-পীড়ন, গ্রেফতার ও নির্যাতনের মাধ্যমে মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের বিতর্কিত ১/১১’র অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নেওয়া সেই ১২৩২ কোটি টাকা কবে ফেরত পাবেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। গত ৯ বছরেও সেই টাকা ফেরত না দিয়ে সরকার প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করেছে। ১/১১’র সরকার যে প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, সেটা অন্যায়ভাবে নিয়েছে। এক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনাও উপেক্ষিত। তবে টাকা ফেরতে আদালতের রায়ের বাস্তবায়ন চায় এফবিসিসিআই।

এদিকে সেই সময়ে হয়রানির শিকার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আজও কোনো অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদকে প্রমাণিত হয়নি। বরং বার বার প্রমাণিত হয়েছে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভুল ছিল। সেই সময়ে ব্যবসায়ীরা মিথ্যা প্রচারণার শিকার ছিলেন। শুধু হয়রানি ও অর্থ আদায় করতে মামলা করা হয় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) প্রথম সহসভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যবসায়ীদের টাকা ফেরত দেওয়া উচিত। জোর-জুলুম করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া যাবে না। আর টাকা ফেরতে আদালত যে রায় দিয়েছে, তার ওপর সবার আস্থা রাখা উচিত। এফবিসিসিআই টাকা ফেরতে সেই রায়ের বাস্তবায়ন চায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, জোর-জবরদস্তি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নেওয়া সেই ১২৩২ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গত মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ওই টাকা ফেরত চেয়ে আসছেন সে সময়ের নির্যাতিত ব্যবসায়ীরা। এরপর দীর্ঘ ৯ বছরেও ওই টাকা ফেরত না পেয়ে হতাশ তারা। গত মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ওই টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রীর সে প্রতিশ্রুতিতে আপত্তি তোলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ফলে গত ৯ বছরেও সে টাকা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সরকার। তবে ব্যবসায়ীরা মনে করেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে হাই কোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক টাকাগুলো প্রকৃত মালিকদের ফেরত দেওয়া। কিন্তু সরকার সেটা না করে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে। তারা বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও ওই টাকা ফেরত দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তখন নিজ উদ্যোগেই টাকা ফেরত দিতে মন্ত্রণালয়ের এগিয়ে আসা উচিত ছিল। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আর এ বিষয়ে যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনা আছে, তাই আমার কথা বলা সমীচীন নয়। জানা গেছে, ২০০৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত একটি গোয়েন্দা সংস্থা এবং তৎকালীন টাস্কফোর্স ইন্টেলিজেন্টস (টিএফআই) কর্মকর্তারা প্রায় ৪০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা আদায় করে। এ টাকা দুই শতাধিক পে-অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ০৯০০ নম্বর হিসাবে জমা হয়। শুধু টাকা আদায়ই নয়, অনেক ব্যবসায়ী তখন জেলও খাটেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গত মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন সময় মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেই এভাবে অর্থ আদায়ের ওই ঘটনাকে অনৈতিক এবং বেআইনি বলে মন্তব্য করেছিলেন। বর্তমানে ওই টাকা কী অবস্থায় আছে— জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টাকাগুলো কীভাবে আছে, তা সরকার জানে। তবে চলতি হিসাবে টাকাগুলো জমা হওয়ায় এ টাকার কোনো সুদ হয়নি। টাকাগুলো সরকার ফেরত দেওয়ার চিন্তা করতে পারে বলে মত দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা। সে সময়ে নির্যাতিত এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু মনে করেন, ১/১১ সরকার অবৈধভাবে টাকা নিয়েছে। আর এই সরকার সেই টাকা ফেরত না দিয়ে অবৈধ কাজ করছে। তিনি এই টাকা সুদে-আসলে ফেরত দিতে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ চান। সূত্র জানায়, ১/১১ সরকার ব্যবসায়ীদের জরিমানার নামে শুধু হয়রানিই করা হয়নি, শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনও করা হয়। সেই নির্যাতনের বিচার ও জোর করে নেওয়া অর্থ ফেরত চান ভুক্তভোগীরা। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন দেশের অন্যতম জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুর আলী। তার দাবি, মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার অন্যায়ভাবে ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। নুর আলীর ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যবসায়ী এই প্রতিবেদককে বলেছেন, তিনি ‘বন্দুকের নলের মুখ থেকে জীবন বাঁচাতে ওই সময়ে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন। ওই সময় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সন্ত্রাসীমূলক আচরণ করা হয়েছে। কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে হুমকি দিয়ে টাকা নেওয়া হয়েছে।’ জানা গেছে, ১/১১ সরকার ২০০৭ সালের ১৯ এপ্রিল জেমস ফিনলের কাছ থেকে আদায় করে ১১৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা। ওই টাকা ১৬টি পে-অর্ডার বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের কনসোলিটেড ফান্ডে প্রথম জমা দেওয়া হয়। এরপর ২২ এপ্রিল একই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৫টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে আরও ১২০ কোটি ২৪ লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়। একই প্রক্রিয়ায় পর্যায়ক্রমে দেড় বছর ধরে বিভিন্ন তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের সংশ্লিষ্ট হিসাবে টাকা জমা হয়েছে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ছাড়াও ‘অজানা’ উল্লেখ করেও সেনাসমর্থিত সরকারের প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা চার দফায় প্রায় ৪৭ কোটি টাকা জমা দিয়েছেন। দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে কয়েক দফায় বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করা হয়েছে ওই সময়। ২০০৭ সালের ২৮ মে থেকে ২০০৮ সালের ১১ জুন পর্যন্ত বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে ২৫৬ কোটি টাকা নেওয়া হয়। ২০০৭ সালের ১৯ জুন থেকে একই বছরের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত মিসেস পারভীন হক সিকদার বাধ্য হয়ে সিকদার গ্রুপের পরিচালক ও সদস্যদের পক্ষ থেকে ৯টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে মোট ৪২ কোটি টাকা পরিশোধ করেন বলে জানা গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আরও যাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়েছে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের ৩০ কোটি, এমজিএইচ গ্রুপ ২৪ কোটি, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ২০ কোটি, কবির স্টিল সাত কোটি, ব্যবসায়ী নুর আলী ৪০ কোটি ৫০ লাখ, আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন ৩২ কোটি ৫০ লাখ, সাগুফতা হাউজিং দুই কোটি ৫০ লাখ, হোসাফ গ্রুপ ১৫ কোটি, পারটেক্স গ্রুপ ১৫ কোটি, স্বদেশ প্রোপার্টিজ ৯ কোটি, ইসলাম গ্রুপ ৩৫ কোটি, কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ৮ কোটি, ব্যবসায়ী রেজাউল করিম ১৭ কোটি, আবু সুফিয়ান ১৪ কোটি, শওকত আলী চৌধুরী ৬ কোটি, আশিয়ান সিটি ১ কোটি, পিংক সিটি ৬ কোটি ৪১ লাখ, বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন ১৯ কোটি ৪৫ লাখ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর ১৫ কোটি, ওয়াকিল আহমেদ ১৬ কোটি, এবি ব্যাংক ফাউন্ডেশন ৩২ কোটি, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ২০ কোটি ৪১ লাখ, এলিট পেইন্ট ২৫ কোটি ৪৪ লাখ, এবি ব্যাংক ১৯০ কোটি, কনকর্ড রিয়েল এস্টেট ৭ কোটি, জনৈক মালিক চার কোটি এবং ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। এফবিসিসিআই ২০১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি একটি ৫ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে গঠিত ওই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয় তৎকালীন এফবিসিসিআই পরিচালক ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যবসায়ী নেতা নুরুল ফজল বুলবুলকে। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন এফবিসিসিআইর তৎকালীন পরিচালক হেলাল উদ্দিন, আবদুর রাজ্জাক, নাজিবুর রহমান ও মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। কমিটি গঠনের প্রায় সাত বছর অতিবাহিত হলেও কোনো সভা ডাকা হয়নি।

সর্বশেষ খবর