সোমবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
আশুলিয়া থানার তুঘলকি কাণ্ড

চাঁদা না দিলেই নাশকতার মামলা

সাঈদুর রহমান রিমন, আশুলিয়া থেকে ফিরে

চাঁদা না দিলেই নাশকতার মামলা

শ্রমিক আন্দোলন ঠেকাতে দায়ের করা মামলাকে পুঁজি করে আশুলিয়া থানা পুলিশ ধুমসে গ্রেফতার-বাণিজ্য চালাচ্ছে। ধার্যকৃত চাঁদা না দিলেই ‘নাশকতা’র মামলায় জড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সেখানে শ্রমিক নেতাদের ধরপাকড় অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পুলিশ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কথিত নাশকতার মৌখিক অভিযোগ তুলছে। তাদের মাথাপিছু পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা ধার্য করে তা জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, শিগগিরই এ দাবি পূরণ না হলে নাশকতার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করে কঠিন শায়েস্তা করা হবে। পুলিশের এমন হুমকি-ধমকিতে গার্মেন্ট কারখানা ঘেঁষা মহল্লাগুলো পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। থানা পুলিশের রাত-দিন ছোটাছুটি আর মারদাঙ্গা দৌরাত্ম্যের মুখে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা পর্যন্ত বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। পুরুষশূন্য বাড়িঘরেও রাত-বিরাতে আশুলিয়া থানা পুলিশ চড়াও হচ্ছে। বাড়িতে থাকা বিভিন্ন বয়সী নারীদের নানাভাবে ভীতি প্রদর্শনসহ হয়রানি চালানোরও গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। কথিত নাশকতার অভিযোগ তুলে পুলিশ ইতিমধ্যে গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, অভিনেতাসহ অন্তত ৪০ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে চালানো হয়েছে নিপীড়ন-নির্যাতন। ভুক্তভোগীদের স্বজন-পরিজনেরা অভিযোগ করে জানান, আশুলিয়া থানার অফিসাস ইনচার্জ (ওসি) মহসীনুল কাদির কী এক অজানা আক্রোশে মেতে উঠেছেন। তিনি শ্রমিক অসন্তোষকে ‘নাশকতা’ আখ্যা দিয়ে গার্মেন্ট মালিকদের পরিবর্তে থানার এসআইদের বাদী বানিয়ে টার্গেটকৃত লোকদের বিরুদ্ধে মামলা সাজাচ্ছেন। পুলিশের করা মামলাগুলোর এজাহারে আসামিদের নাম উল্লেখ করে ‘চাঁদাবাজি’র পথ বানানো হয়েছে। পোশাক শিল্পে অসন্তোষের ঘটনায় উসকানির অভিযোগে ২১ ডিসেম্বর ১৫ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ৭০ জনকে আসামি করে এ ধরনের একটি মামলা করেন আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মহিদুল ইসলাম। ওই মামলায় রোজ গার্মেন্টের মালিক, অভিনেতা এ আর মন্টুকে এজাহারনামীয় আসামি বানানো হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে করা মামলায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য দেওয়ান মো. সালাউদ্দিন বাবু, তার ভাই সাভার উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দেওয়ান মাঈনুদ্দিন বিপ্লব, থানা যুবদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক দুলাল মীর, উপজেলা বিএনপির মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানসহ সাভার ও আশুলিয়ার বিএনপি নেতারা,  ঝুট ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ওই মামলায় সাভার উপজেলা বিএনপির মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি নেতা, ঝুট ব্যবসায়ী ও শ্রমিক নেতাসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া পলাতক আসামি বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য দেওয়ান মো. সালাউদ্দিন বাবু, তার ভাই সাভার উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দেওয়ান মাঈনুদ্দিন বিপ্লবসহ অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এদিকে রোজ কারখানার মালিক মন্টুকে গ্রেফতারের পর তার বিত্তশালী স্বজনদের বাড়িঘরেও হানা দিচ্ছে পুলিশ। শ্রমিক অসন্তোষকে কেন্দ্র করে হামিম গ্রুপের পাঁচ শতাধিক শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ওই কারখানার ১৩৫ জন শ্রমিককে বরখাস্ত করা হয়। আটক করা হয় আট শ্রমিক নেতাকে। অবৈধভাবে প্রবেশ, ভাঙচুর ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কারখানার দুই শ্রমিকের নাম উল্লেখ করে এ মামলা করা হয়। আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহসিনুল কাদির বলেন, হামিম গ্রুপ তাদের কারখানার দুই শ্রমিকের নাম উল্লেখ করে এবং পাঁচ শতাধিক শ্রমিককে অজ্ঞাত আসামি করে আশুলিয়া থানায় একটি মামলা করেছে। পাশাপাশি বাইপাইল এলাকার ফাউন্টেন গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড ও উইন্ডির ২৫৬ জন শ্রমিককে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২১ জন শ্রমিককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে উইন্ডি কর্তৃপক্ষ। আশুলিয়া থানার এসআই শাহাদাৎ হোসেন জানান, উইন্ডি অ্যাপারেলস লিমিটেড ও ফাউন্টেন গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ ২৪৯ জন শ্রমিকের বিরুদ্ধে ‘উসকানি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অভিযোগে দুটি মামলা করে। মামলা হওয়ার পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে জামগড়া, বগাবাড়ী বাজার, ইউনিক স্ট্যান্ড ও বাইপাইল এলাকা থেকে ২৩ জনকে গ্রেফতার করে। শ্রমিক আন্দোলন ঘিরে করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার সেগুনবাগিচা এলাকায় সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতিকালে পুলিশের একটি দল শ্রমিক নেতা মোশরেফা মিশুকে গ্রেফতার করে। এ ছাড়া আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গার্মেন্ট শ্রমিক ফ্রন্টের সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি সৌমিত্র কুমার দাশ, গার্মেন্ট অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আল কামরান ও সাধারণ সম্পাদক শাকিল এবং বাংলাদেশ তৃণমূল গার্মেন্ট শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শামীম খান, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির (বিসিডব্লিউএস) আশুলিয়ার সংগঠক মো. ইব্রাহিম ও টেক্সটাইল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের আহ্বায়ক মো. মিজানকে গ্রেফতার করা হয়। শ্রমিক অসন্তোষের ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ দুটি ও কারখানা কর্তৃপক্ষ আটটি মামলা করেছে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিজিএমইএ এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ৩১ জনকে নাশকতা সৃষ্টির অন্যতম হোতা হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু আশুলিয়া থানা পুলিশ নাশকতা সৃষ্টিকারী হিসেবে ১৫০ জনকে চিহ্নিত করে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। গ্রেফতার করা হয়েছে শ্রমিক নেতা, চেয়ারম্যান, অভিনেতা, সাংবাদিকসহ অন্তত ৪০ জনকে। পুলিশ ও গার্মেন্ট কারখানাগুলোর পক্ষ থেকে করা মামলায় কয়েকজনের নাম উল্লেখসহ সহস্রাধিক অজ্ঞাত শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে। প্রতিটি মামলায় উল্লেখ করা ‘অজ্ঞাত’ আসামিদের ফাঁদটি খুব জুতসইভাবেই ব্যবহার করছে আশুলিয়া থানা পুলিশ। এখন প্রতিদিন ভোরে কারখানায় যোগদানকালে এবং রাতে ছুটির পর শ্রমিকরা বেরোলেই পুলিশ তাদের আটক করে থানায় নিয়ে যায়। দরকষাকষি শেষে লেনদেন সম্পন্ন হলে রাতেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এমন ধরা-ছাড়ার বাণিজ্যে আশুলিয়া থানা পুলিশ প্রতিদিন গড়ে লক্ষাধিক টাকা কামিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু জানান, গভীর রাতে জামগড়া, বাইপাইল, ইউনিক এলাকা থেকে তাদের সংগঠনের বিভিন্ন নেতাকে পুলিশ গ্রেফতার করছে। শ্রমিক নেতাদের আটকের খবরে সাধারণ শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই গ্রেফতারের ভয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। শিল্প পুলিশ-১-এর পরিচালক মোস্তাফিজার রহমান বলেন, যে কোনো বিশৃঙ্খলা এড়াতে কারখানাগুলোর প্রধান ফটকে এবং শিল্পাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন রয়েছে। আশুলিয়া থানার এসআই শাহাদাতের বাদী সেজে রুজু করা অপর মামলায় আসামি বানানো হয় সাংবাদিক নাজমুল হুদাকে। এ মামলাটির মাধ্যমে স্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে পুলিশের মামলা-বাণিজ্যসহ নানা অনাচারের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে না বললেই চলে। প্রসঙ্গত, ১২ ডিসেম্বর আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল এলাকার চার-পাঁচটি পোশাক কারখানায় মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকরা কর্মবিরতি শুরু করে। কয়েক দিনের মধ্যে ওই অসন্তোষ শিল্পাঞ্চলের অর্ধশতাধিক কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে বিজিএমই কর্তৃপক্ষ ৫৫টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। তবে আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ ডিসেম্বর থেকেই গার্মেন্টগুলো খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে গার্মেন্ট মালিকরা আলোচনার সমঝোতায় গেলেও পুলিশ সরাসরি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাবে মাঠে নেমেছে। গার্মেন্ট মালিক ও পুলিশের পক্ষ থেকে করা ১০ মামলার অভিযুক্ত ‘অজ্ঞাতদের’ সন্ধানে বিরতিহীন অভিযান চালাচ্ছে আশুলিয়া থানা পুলিশ। ফলে পুলিশি ধরপাকড়, হয়রানি ও ঘুষ-বাণিজ্যের ধকল থেকে রেহাই পেতে শত শত শ্রমিক আশুলিয়া ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। কর্মবিরতি, ভাঙচুর বা আন্দোলনে অংশ না নিলেও তারা কারখানার কাজে অংশ নেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না।

সর্বশেষ খবর