বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

এবার পরীক্ষা ইসি নিয়ে

নতুন ইসি গঠনে কাজ করবে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি, চ্যালেঞ্জ থাকবে কর্মপরিধিতে

গোলাম রাব্বানী ও রফিকুল ইসলাম রনি

এবার পরীক্ষা ইসি নিয়ে

নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এই কমিটিতে কমপক্ষে একজন নারীসহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে শূন্য পদের বিপরীতে দুইজনের নাম সুপারিশ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ১০ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে রাষ্ট্রপতির কাছে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য নাম সুপারিশ করতে বলা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সার্চ কমিটির প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এ ছাড়া প্রজ্ঞাপনে কমিটির কার্যবিধি ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর আগে সকালে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। এদিকে স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য ইসি গঠনে ‘নিরপেক্ষ সদস্য’ খুঁজে বের করাটাও সার্চ কমিটির জন্য কঠিন পরীক্ষা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কর্মপরিধি নিয়েও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে সার্চ কমিটিকে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো আইন করার প্রস্তাব দিলেও সময়-স্বল্পতার কারণে তা আর হয়নি। এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমেই ইসি গঠন হচ্ছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। তাদের মেয়াদ রয়েছে আর মাত্র ১২ দিন। ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে বিদায় নেবেন তারা।

এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবদুল ওয়াদুদ সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে ইসি গঠনের লক্ষ্যে এই সার্চ কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য গ্রহণকল্পে নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য রাষ্ট্রপতি একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশনা প্রদান করেন। তত্পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অদ্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে।’

নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম প্রস্তাবকারী এই সার্চ কমিটির প্রধান করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে। বর্তমান ইসি গঠনে ২০১২ সালেও একই দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। গতবারের মতো এবারও সার্চ কমিটিতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি থাকছেন। এবার এ দায়িত্ব পেলেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। কমিটিতে থাকছেন সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক ও কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) মাসুদ আহমেদ। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. শিরীন আখতারকে সার্চ কমিটিতে নেওয়া হয়েছে।

আপিল বিভাগের বিচারপতি মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে গতবার সার্চ কমিটিতে ছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, পিএসপির তৎকালীন চেয়ারম্যান এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী ও তৎকালীন সিএজি আতাউল হাকিম। গতবার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান চারজনের সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন। এবার সদস্য সংখ্যা দুজন বাড়িয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে এতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন বতর্মান রাষ্ট্রপতি। প্রয়াত জিল্লুর রহমানের মতোই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মাসব্যাপী সংলাপের পর গতকাল সার্চ কমিটি গঠন করেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।

সকালে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়ে চিঠি পাওয়ার পর সারসংক্ষেপ তৈরি করে তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সেখান থেকে ফাইল ফেরত আসার পর সন্ধ্যায় ছয় সদস্যের সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটির প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। নবগঠিত সার্চ কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে সরকারি এই দফতর। এর আগে বঙ্গভবনের চিঠি পাওয়ার পর দুপুরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে দেখা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। পরে তারা দুজন সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

সার্চ কমিটির কার্যবিধি ও কর্মপদ্ধতি : মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে— ‘১. প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক হইবেন। ২. মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অনুসন্ধান কমিটির কার্যসম্পাদনে প্রয়োজনীয় সাচিবিক সহায়তা প্রদান করিবে। ৩. তিনজন সদস্যের উপস্থিতিতে অনুসন্ধান কমিটির কোরাম গঠিত হইবে। ৪. অনুসন্ধান কমিটি ন্যূনপক্ষে একজন নারীসহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সুপারিশ প্রদানের উদ্দেশ্যে সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুইজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করিবে এবং সিদ্ধান্তের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা থাকিবে। ৫. অনুসন্ধান কমিটি সভার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করিতে পারিবে। ৬. গঠনের ১০ (দশ) কার্যদিবসের মধ্যে অনুসন্ধান কমিটি ইহার সুপারিশ রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবে।’

জানা গেছে, যেসব দল ‘নতুন কমিশনের’ জন্য নাম প্রস্তাব করেনি তাদের কাছে আবারও নামের তালিকা চাওয়া হতে পারে। এ ছাড়া সাবেক সচিব, বিচারপতিদের নামের তালিকাও করবে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এরপর দলের প্রস্তাবিত নাম ও কমিটি অনুসন্ধান করে বিশেষ কিছু নাম রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করবে। পরে সে তালিকা থেকে চূড়ান্ত হবে নতুন নির্বাচন কমিশনের নাম। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে গত বছর ১৮ ডিসেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেন রাষ্ট্রপতি। সংলাপ শেষ হয় চলতি বছর ১৮ জানুয়ারি। এই সময়ে রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ ৩১টি দলের সঙ্গে সংলাপ করেন। কারা আসছেন নতুন নির্বাচন কমিশনে, তা নিয়ে সর্বত্র চলছে আলাপ-আলোচনা। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান কমিশনের বিদায়ের পর দায়িত্ব নেবে নতুন নির্বাচন কমিশন। তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতিমধ্যে এ নির্বাচনে ই-ভোটিং চালু করার প্রস্তাব করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮(১)-এ বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’

এর আগে ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে নামের সুপারিশ তৈরি করতে চার সদস্যের সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, বাংলাদেশের মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান। সে সময় ইসি গঠন নিয়ে ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ ২৩টি দলের মতামত নেন রাষ্ট্রপতি। সংলাপে অধিকাংশ দলই সংবিধান অনুসারে সিইসি ও ইসি নিয়োগে আলাদা আইন করা বা অনুসন্ধান কমিটির পক্ষে মত দেয়। সার্চ কমিটির আহ্বানে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল নতুন কমিশনের জন্য তাদের পছন্দের ব্যক্তির নামের তালিকা দিলেও বিএনপি কোনো নাম দেয়নি। ওই কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে যে সুপারিশ জমা দেয়, তাতে সিইসি ও চার কমিশনার নিয়ে পাঁচ পদের জন্য ১০টি নাম আসে। তার মধ্য থেকেই পাঁচজনকে বেছে নেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির আদেশের পর ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরদিন প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিয়েই তারা যোগ দেন ইসিতে। সেই হিসেবে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও তিন নির্বাচন কমিশনার এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি আরেক নির্বাচন কমিশনারের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর