সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাজার অভাব নেই টেকনাফে

চারদিকে বড় বড় প্রাসাদ, বিদেশি ফিটিংস, নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী, অচেনা লোক গেলেই ট্রলারে তুলে ছেড়ে দেয় মধ্য সাগরে

মির্জা মেহেদী তমাল, টেকনাফ (কক্সবাজার) থেকে ফিরে

রাজার অভাব নেই টেকনাফে

সীমান্ত জনপদ টেকনাফের দুটি পাশাপাশি গ্রাম মৌলভীপাড়া ও নাজিরপাড়া। শহর থেকে একটু ফাঁকে। সেই দুটি গ্রামের দিকে যেতে হলে ভাঙাচোরা আর মাটির সড়ক দিয়েই যেতে হয়। কিন্তু কী আশ্চর্য! কিছুদূর যেতেই পথ ও পরিবেশের আকস্মিক পরিবর্তনে নতুন যে-কেউ ভড়কে যাবেন। হঠাৎ কংক্রিটের রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সামান্য কিছু যেতেই কারুকাজ করা বিরাট লোহার কপাট। কপাটের ফাঁকফোকর দিয়ে ভিতরে তাকাতেই চোখে পড়বে প্রাসাদোপম বাড়ি। সামনে খোলা জায়গা। রাস্তার ডান পাশ বা বাঁ পাশ, দুই পাশেই একের পর এক এমন সব বিশাল আকারের বাড়ি। তবে সবগুলোই রংবেরঙের। কোনো কোনো বাড়ির পাশেই সুইমিং পুল। পার্ক করা দামি গাড়ি। স্থানীয়রা এসব বাড়িকে রাজপ্রাসাদ বলে। আর এই রাজপ্রাসাদের  রাজা যারা, তারা হলেন হঠাৎ কোটিপতি বনে যাওয়া ইয়াবা মাফিয়া। রাজাদের কেউ বছর কয়েক আগেও ছিলেন কৃষক, কেউ গরু ব্যবসায়ী, কেউ বাসের হেলপার, কেউবা বিক্রি করতেন পিঠা। কিন্তু ইয়াবা নামের আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়ায় এরা এখন টেকনাফের রাজা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এমন হঠাৎ কোটিপতি বনে যাওয়া রাজার অভাব নেই টেকনাফে। শত শত রাজা যেমন আছে, তেমনি শত শত রাজপ্রাসাদও আছে এখানে। রাজপ্রাসাদের কোনোটি দ্বিতল, কোনোটি ত্রিতল। দৃষ্টিনন্দন এসব বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য আছে সিসিটিভি ক্যামেরাও। রাজপ্রাসাদের ভিতরের পাঁচ তারকা হোটেলের অত্যাধুনিক ফিটিংস। এলাকায় জনশ্রুতি আছে, এদের কেউ কেউ টাকার বালিশে মাথা রেখে ঘুমান। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের জৌলুশ আর চাকচিক্যময় যতগুলো বাড়িঘর রয়েছে টেকনাফ উপজেলায়, বাংলাদেশের অন্য কোনো উপজেলায় তা নেই বলেই মনে করেন অনেকে। আর এই ইয়াবা মাফিয়ারা যেমন অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ঠিক তেমনি এখন প্রভাবশালী। অবৈধ অস্ত্রের ঘাঁটিও রয়েছে তাদের এই রাজপ্রাসাদে, যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার সাহস টেকনাফে কারও নেই। পুলিশ প্রশাসনও তাদের কাছে অসহায়। তাদের এলাকায় কোনো অচেনা লোক দেখলেই রাজাদের পাইক-পেয়াদারা ধরে নিয়ে যায়। বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে ট্রলারেও উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। ওই লোকদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল মধ্য সাগরে, যাদের কখনোই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন ঘটনা টেকনাফের মানুষের মুখে মুখে। ইয়াবা মাফিয়াদের শুধু টেকনাফেই নয়, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় রয়েছে তাদের অঢেল সম্পদ। গত সপ্তাহে সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, বছর কয়েক আগেও এসব গ্রামের অধিকাংশ লোকের নুন আনতে পান্তা ফুরাত। সেখানে এখন সারি সারি রাজকীয় বাড়ি। চারদিকে জৌলুশ আর চাকচিক্যময়তার ছাপ। কোথাও যেন দারিদ্র্যের লেশমাত্র নেই। এখানে সবার হাতে রয়েছে ইয়াবা নামক এক সোনার চাবি। ইয়াবার অবাধ ব্যবসার বদৌলতে মৌলভীপাড়া ও নাজিরপাড়া গ্রামের কয়েকশ পরিবার বিত্তহীন থেকে কোটিপতিতে পরিণত হয়েছে। শুধু মৌলভীপাড়া ও নাজিরপাড়া নয়, এ অবস্থা এখন হ্নীলা ফুলের ডেইল, জাদিমুরা, হোয়াইক্যং, লেদাসহ টেকনাফের অনেক এলাকাতেই। আর কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের রঙ্গিখালীর লেদা এলাকায় তৈরি হওয়া বিরাট বাড়িগুলোরও মালিক ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা ব্যবসায়ী। স্থানীয়রা জানান, টেকনাফ-উখিয়ার এই রাজাদের ভাগ্য পরিবর্তন রূপকথার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। রাজাদের কেউ বছর কয়েক আগেও ছিলেন কৃষক, কেউ গরু ব্যবসায়ী। কেউবা বিক্রি করতেন পিঠা। কিন্তু ইয়াবা নামের আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়ায় গ্রামের নুরুল হুদা, আমীর আহমদ, আলী হোসেন, মঞ্জুর আলমরা এখন কোটিপতি। তাদের তৈরি কোটি টাকার এসব রাজপ্রাসাদে ইতিপূর্বে অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর উদ্ধার করেছে ইয়াবা। পেয়েছে ইয়াবা তৈরির সরঞ্জামও। টেকনাফ উপজেলার কয়েকজন সমাজকর্মী আক্ষেপ করে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালালেও পুলিশের খাতায় আলোচিত এসব ইয়াবা ব্যবসায়ী সব সময় পলাতক। এলাকাবাসী বলছেন, পলাতক নয়, এরা দিব্যি বাড়িতে থেকে প্রতিদিন কোটি টাকার ইয়াবা ব্যবসা করেন। পুলিশ মাঝেমধ্যে তাদের আস্তানায় হানা দিলে ঘটে যায় বিপত্তি।

রূপকথার গল্প নয়, সত্যি : ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কোটিপতি বনে যাওয়ার গল্প রূপকথাকেও হার মানিয়েছে। স্থানীয় লোকজন, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে তাদের ভাগ্য ফেরানোর নানা গল্প পাওয়া গেছে। এদের কেউ ছিলেন দিনমজুর, কেউ ছিলেন পিঠা ব্যবসায়ী, যাদের প্রত্যেকেই এখন টেকনাফের রাজা। সেটি আবার অল্প সময়ের মধ্যেই। এমনই রূপকথাকে হার মানিয়েছে টেকনাফের ছয় ভাই, যারা ইয়াবা বেচে এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। ১০ বছর আগেও তিনি ছিলেন গাড়ির হেলপার। কিছুদিন পর হেলপার থেকে হন চাঁদের গাড়ির (জিপ) ড্রাইভার। কিন্তু গাড়ি চালালেও চলছিল না তার পরিবার। তাই যুক্ত হন চোরাচালানের সঙ্গে। মিয়ানমারে প্রথমে পাচার করতে থাকেন সার। এরপর শুরু করেন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ‘সুখী’র পাচার। এভাবেই চেনা হয় চোরাচালানের অলিগলি। শুরু করেন ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবার পাচার। মাত্র পাঁচ বছর এ মাদক বেচাকেনা করে আমূল বদলে গেছেন তিনি। টেকনাফের লেদায় হয়েছে তার কোটি টাকার বাড়ি। কোটি কোটি টাকার জায়গা কিনেছেন পর্যটন শহর কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে। কিনেছেন একাধিক গাড়ি ও ট্রলার। হেলপার থেকে কোটিপতি ইয়াবার ছোঁয়ায় রাতারাতি ধনী বনে যাওয়া এই ব্যক্তির নাম নুরুল হুদা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় নাম থাকা এ ব্যক্তিকে এলাকায় চেনে ‘ইয়াবা হুদা’ নামে। নুরুল হুদা একা নন, মাদকের সঙ্গে সখ্য গড়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তার অন্য পাঁচ ভাইও। অথচ পাঁচ বছর আগেও তার ভাইদের কেউ অন্যের ঘরে কামলার কাজ করতেন, কেউবা কাজ করতেন কৃষিজমিতে। সেই ভাইদের মধ্যে এখন কারও আছে পাঁচতলা আবাসিক কটেজ, কারও আছে পাঁচতলার সুরম্য ভবন। তাদের বাড়ি টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নে। তাদের স্ত্রীরাও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। কয়েক বছর আগে পিঠা বিক্রি করতেন আমির আহমদ। নির্দিষ্ট কোনো দোকান না থাকায় ভ্যানগাড়িতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েই বিক্রি করতেন পিঠা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে সবকিছু। আমির এখন ‘লেইট্যা আমির’। ভ্যানগাড়ির পরিবর্তে তিনি এখন চড়েন দামি প্রাইভেট কারে। একসময়ের ভাসমান আমির এখন থাকেন ডুপ্লেক্স বাড়িতে। সব পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করেছেন ব্যবসাও। পিঠার পরিবর্তে তিনি এখন বিক্রি করেন ইয়াবা! আর ইয়াবার ঝলকেই একসময়ের ভাসমান আমির এখন কোটিপতি। রাজপ্রাসাদের রাজা। মৌলভীপাড়ার বাসিন্দা হাজী ফজল আহমদের ছেলে আবদুর রহমানের বয়স এখন ২৮। বছর চারেক আগেও তিনি কর্মহীন বেকার হয়ে এলাকায় ভবঘুরে ছিলেন। এখন তিনি চড়েন নতুন মডেলের ঝকঝকে একটা নোয়া মাইক্রোবাসে। তিনিও এখন ইয়াবা ব্যবসা করে একটি রাজপ্রাসাদের মালিক। একসময় ছাগলের ব্যবসা করতেন হাসু। এ জন্য এলাকায় তিনি ‘ছাগল হাসু’ নামে পরিচিত। তবে ছাগল হাসু এখন এলাকার অন্যতম কোটিপতি। টেকনাফ থানাসূত্র জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে ইয়াবা চোরাচালানের একাধিক মামলা রয়েছে। নাজিরপাড়া এলাকায় আগে চান মিয়া নামের একজন বয়স্ক চোরাকারবারি থাকতেন। চেনার সুবিধার জন্য এলাকাবাসী তার নাম দেন ‘পোয়া চান মিয়া’। স্থানীয় ভাষায় ‘পোয়া’ অর্থ ছোট। এই পোয়া চান মিয়ার কত টাকা আছে তা নিয়ে এলাকাবাসীর কৌতূহলের শেষ নেই। টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়কের পাশে তার বিলাসবহুল বাড়ির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। অথচ পোয়া চান মিয়ার বৈধ কোনো আয়ের উৎস নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, নাজিরপাড়া সীমান্ত দিয়ে ‘সুখী বড়ি’সহ বিভিন্ন ধরনের দেশীয় মূল্যবান ওষুধ পাচার করেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ইয়াবা চোরাচালানের অভিযোগে একাধিক মামলা থাকলেও তাকে পুলিশ স্পর্শ করে না। টেকনাফে এমন শত শত রাজার গল্প রয়েছে। একই ধরনের গল্প আছে উখিয়াতেও। ইয়াবা ব্যবসায়ী খোকা, মাহমুদুল হক ও বাবুল মিয়া রাস্তা থেকে এখন কোটিপতি। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, কয়েক বছর আগেও মাহমুদুল করিম খোকা নামের যুবকটি অন্যের মাইক্রোবাসে হেলপারি করে টানাটানির সংসারে দিনানিপাত করতেন। কিন্তু এক-দুই বছরের ব্যবধানে বদলে গেছে তার জীবনযাত্রা। ইয়াবা পাচার করে তিনি বর্তমানে একাধিক প্রাইভেট কার, ডাম্পার ট্রাক, সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেলের মালিক। গড়ে তুলেছেন নামে-বেনামে একাধিক সম্পদ। উখিয়া রেঞ্জের উখিয়া সদর বনবিটের রিজার্ভ বনভূমির টিলা কেটে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে গড়ে তুলেছেন আধুনিক পাকা ভবন। বাড়ির চারদিকে লাগানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। বাইরে থেকে মনে হবে কোনো রাজপ্রাসাদ। উখিয়ার আরেক আলোচিত বাবুল মিয়া পাঁচ বছর আগেও ছিলেন গাড়ির হেলপার। তিনি এখন কোটিপতি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর