শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সুষ্ঠু ভোটের অঙ্গীকারে যাত্রা ইসির

নতুন সিইসি ও কমিশনারদের শপথ । চ্যালেঞ্জ আছে, অটল-আপসহীন থাকব, সব দলকে আস্থায় আনতে কাজ করব, সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই : নূরুল হুদা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সুষ্ঠু ভোটের অঙ্গীকারে যাত্রা ইসির

সুষ্ঠু ভোটের অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু করল দেশের দ্বাদশ নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসিতে যোগ দিয়ে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে কারও সঙ্গে কোনো আপস না করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। সেই সঙ্গে কারও দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে— আপসহীন, অটল ও নিরপেক্ষ থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তিনি। এ জন্য রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব নাগরিকের সহযোগিতা চেয়েছেন। তবে দেশের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়াই অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন নবনিযুক্ত সিইসি। গতকাল শপথ নেওয়ার পরে কর্মস্থল নির্বাচন কমিশনে যোগ দিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন নতুন সিইসি। প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবের পাশাপাশি ইসি নিয়ে নানা পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

এর আগে বিকাল ৩টায় প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নেওয়ার পর সাড়ে ৪টায় ইসিতে যোগ দেন সিইসিসহ পাঁচ নির্বাচন কমিশনার। ইসি সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ তাদের অভ্যর্থনা জানান। পরে সিইসি তার চার সঙ্গীকে নিয়ে নিজ কক্ষে বসে আনুষ্ঠানিকতা সারেন। আধা ঘণ্টা পরে অতীতের সব রেওয়াজ ভেঙে অন্য নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে নিয়ে উন্মুক্ত লনে প্রেস ব্রিফিং করেন সিইসি নূরুল হুদা। আগের সিইসিরা সংবাদ সম্মেলনে করতেন ইসির মিডিয়া সেন্টারে। সংবাদ সম্মেলনের প্রথমেই কে এম নূরুল হুদা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যারা অবদান রেখেছেন তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। একই সঙ্গে ইসিতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।

নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, আমরা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে শপথ গ্রহণ করেছি। সংবিধান ও সংবিধানের অধীনে প্রণীত আইনকানুন বিধিবিধানের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালনে অটল এবং আপসহীন থাকব। সেই সঙ্গে সাংবিধানিক এ সংস্থাকে প্রভাবমুক্ত রেখে, নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করে সব রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জনে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলকে আমরা আস্থায় আনতে পারব, এই আত্মবিশ্বাস আমাদের আছে।

দেশের দ্বাদশ সিইসি হিসেবে ইসিতে যোগ দিলেন সাবেক আমলা নূরুল হুদা। নতুন নির্বাচন কমিশনার হয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে নতুন ইসিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি নতুন সিইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত ৬ ফেব্রুয়ারি নতুন ইসি নিয়োগ দেন। ওই দিনই সার্চ কমিটি নতুন ইসির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নাম সুপারিশ করেন। সেই তালিকা থেকেই রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশন নিযুক্ত করেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি নতুন ইসি গঠনের লক্ষ্যে ৩১ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সংলাপ করেন। এর ভিত্তিতে তিনি গত ২৫ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন।

নতুন সিইসি বলেন, শপথ নেওয়ার পর থেকেই আমাদের ওপরে ইসির আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাদের নিয়োগ দিয়ে ইসির যে গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন, আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সংবিধান, দেশের প্রচলিত আইন ও নির্বাচনবিধি মেনেই পালন করতে বদ্ধপরিকর।

সিইসি বলে, নির্বাচন কমিশনে আজ (গতকাল) আমাদের প্রথম দিন। আমরা ইসির দায়িত্ব, কাজ ও আইন-বিধি সম্পর্কে জানব। চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিবালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী কার্যক্রম হাতে নেবেন। প্রথম কাজ হবে আলোচনা করবে নিজেদের মধ্যে, দেখব, বুজব, সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পরিকল্পনা নেব। একই সঙ্গে ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ১১টি ইসির রেখে যাওয়া অভিজ্ঞতা ও দিক নির্দেশনাও জানব। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইসির অন্যতম তিনটি দায়িত্বের পাশাপাশি অন্য কাজগুলোও তুলে ধরেন তিনি। ১৯৭২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪৫ বছর ধরে ধাপে ধাপে ইসি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসি সচিবালয়ে রয়েছে সুদক্ষ জনবল। ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সাবেক নির্বাচন কমিশনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ভাণ্ডারের অনুসরণীয় দিক নির্দেশনা কাজে লাগাব।

ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল, বিএনপি জোটের অবস্থান ও নির্বাচনমুখী পরিবেশে যোগ দিয়েই চ্যালেঞ্জ কী মনে করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে নতুন সিইসি বলেন, আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ একটাই— দেশের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়া। এ জন্যে আমরা কাজ করে যাব। সরকারের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে নূরুল হুদা বলেন, সাংবিধানিক কাজে সরকারের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই। আমরা সাংবিধানিক দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে পালন করব; কারও দ্বারা প্রভাবিত হব না। আস্থা অর্জনে দলগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি সহায়তাও চান তিনি। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল ও সবার আস্থা অর্জনে কাজ করে যাব। আমরা কাজের মাধ্যমে এমন অবস্থান সৃষ্টি করব যাতে সবার আস্থা অর্জনে সক্ষম হব বলে আমি বিশ্বাস করি। নির্বাচনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবৈধ প্রভাব দমনে কঠোর হবেন বলে জানান সিইসি। তিনি বলেন, আমরা যে কোনো প্রভাব, হস্তক্ষেপ কঠোরভাবে মোকাবিলা করব; আইনবিধির বাইরে কোনো কিছুকেই প্রশ্রয় দেব না।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল বা আছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নূরুল হুদা বলেন, আজকে শপথ নেওয়ার পর কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। যে শপথ নিয়েছি, নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছি, সেভাবেই কাজ করব। আওয়ামী লীগের কোনো নির্বাচনী বোর্ডের দায়িত্বেও ছিলেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন নূরুল হুদা। জনতার মঞ্চের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগও নাকচ করে দেন নূরুল হুদা। তিনি বলেন, এটা ঠিক নয়। মিথ্যা কথা।

বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল সিইসির সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততার অভিযোগ করে আসছে। এদিকে আজ সকালে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিতে স্মৃতিসৌধে যাওয়ার কথা রয়েছে নতুন ইসির। এরপরে প্রথম বৈঠকে বসবেন তারা।

সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজনের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করার শপথ নিলেন নতুন নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা। সাবেক সচিব কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের এই কমিশনের অধীনেই আগামী পাঁচ বছর জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সব ভোট হবে। তাদের অধীনেই হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গতকাল বিকালে সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে নতুন ইসির এই সদস্যদের শপথ পড়ান। সিইসি নূরুল হুদাসহ নতুন কমিশনের সদস্যরা বেলা ২টা ৫০ মিনিটের মধ্যেই জাজেস লাউঞ্জে পৌঁছে যান। প্রধান বিচারপতি প্রথমে শপথ পড়ান সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে। সিইসি শপথনামায় সই করার পর তাকে অভিনন্দন জানান প্রধান বিচারপতি। এরপর একে একে অন্যান্য কমিশনার শপথ নেন। শপথ পরিচালনা করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। নতুন ইসি গঠনের জন্য সার্চ কমিটির নেতৃত্ব দেওয়া বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ছাড়াও আপিল বিভাগের বিচারক এবং সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশন এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন এ অনুষ্ঠানে।

আসা-যাওয়া ইসির

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বে এ পর্যন্ত ১১ জনকে দেখেছে এ দেশের মানুষ, যাদের মধ্যে সাতজন ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বা সাবেক বিচারক; চারজন ছিলেন সাবেক আমলা। আর তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ছিলেন ২৩ জন। সাবেক ১১ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে ছয়জন স্বাধীনতা পরবর্তী দুই যুগ টানা দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক বিচারপতিরা। এরপর ইসিতে শুরু হয় সাবেক আমলাদের নেতৃত্ব। মাঝখানে ২০০৫ সালে এক বছর সাত মাস একজন সাবেক বিচারপতি ছাড়া গত প্রায় ২০ বছর সাবেক আমলারাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

সর্বশেষ খবর