মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

এক ভয়ঙ্কর খুনি রানা

আত্মগোপনে ছিলেন মালয়েশিয়ায়, পলাতক থেকেই স্লিপার সেল পরিচালনা

সাখাওয়াত কাওসার

এক ভয়ঙ্কর খুনি রানা

নিষিদ্ধ উগ্রপন্থি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) শীর্ষ নেতা রেজওয়ানুল আজাদ রানা। তিনি ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। কখনো ঢাকা, কখনো কুয়ালালামপুর পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ভয়ঙ্কর ‘স্লিপার সেল’-এর। অবশেষে ধরা পড়েছেন পলাতক এই আসামি। স্বস্তি ফিরে এসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলাতক থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন জঙ্গিদের ভয়ঙ্কর স্লিপার সেলের। এই সেলের একের পর এক হত্যা এবং হত্যাচেষ্টার মতো ভয়ঙ্কর সব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের কাছ থেকে ‘বড় ভাই’য়ের (রানা) তথ্য আদায়ের পরও অনেকটা অসহায় ছিলেন গোয়েন্দারা। কোনো কূলকিনারাই হচ্ছিল না।

গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকা থেকে রানাকে গতকাল গ্রেফতার করে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) একটি টিম।

সিটিটিসি সূত্র বলছে, ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার তদন্তে নাম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই গা ঢাকা দেন রানা। কিছুদিন দেশে থাকার পর পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। কুয়ালালামপুরে থাকলেও নাম পাল্টে গোপনে অন্য পাসপোর্টে মাঝেমধ্যেই দেশে আসতেন তিনি। পলাতক থেকেই সমন্বয় করছিলেন স্লিপার সেলের। তার নির্দেশনা ও পরিকল্পনাতেই একের পর এক ব্লগার, প্রকাশক ও লেখকদের হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজীব হায়দার হত্যার ঘটনায় ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর রানাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়, ৩০ মার্চ তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ১২ মে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস, ৭ আগস্ট ঢাকার গোড়ানে ব্লগার নিলয় নীল, ৩১ অক্টোবর শাহবাগে প্রকাশক ও লেখক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা ও লালমাটিয়া শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল হত্যাচেষ্টা এবং সর্বশেষ গত বছরের ২৫ মার্চ কলাবাগানে সমকামীদের অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয় হত্যার ঘটনার সঙ্গে এই রানার কোনো না কোনোভাবে যোগসূত্র রয়েছে।

সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘রানা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ নেতা। দুর্ধর্ষ জঙ্গি। ব্লগার রাজীব হত্যার মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। এ ছাড়া ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন ও মনিপুর স্কুলের শিক্ষক হত্যাচেষ্টা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি তিনি। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছিলাম।’

সিটিটিসি সূত্র জানায়, গ্রেফতার রানার গ্রামের বাড়ি ফেনীর দাগনভূঞার উত্তর জয়লস্করপুরে। তার বাবার নাম আবুল কালাম আজাদ। মায়ের নাম মমতাজ বেগম। ঢাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই ব্লকের ১৮৭/সি নম্বর বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তিনি। ১৯৮৮ সালের ২৬ আগস্ট জন্ম নেওয়া রানা ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৫ সালে এসএসসি ও নটর ডেম কলেজ থেকে ২০০৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে। নর্থ সাউথে পড়ার সময় তিনি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা জসিম উদ্দিন রাহমানীর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন তিনি। এ ছাড়া সিরিয়ায় পাড়ি দেওয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র জুন্নুন শিকদারের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কাজী রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। শুরুর দিকে এবিটির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও একপর্যায়ে রানা নব্য জেএমবিতে যোগ দেন। তার মাধ্যমেই নর্থ সাউথসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, রানা ছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ। বাংলার পাশাপাশি তিনি ইংরেজি ও আরবি ভাষাতেও দক্ষ ছিলেন। এ কারণে অল্প দিনেই তিনি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ নেতা হয়ে ওঠেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্লিপার সেলের মাধ্যমে দলের সদস্যদের পরিচালনায়ও ছিলের তিনি সিদ্ধহস্ত। মালয়েশিয়ায় আত্মগোপনে থেকেই দেশে থাকা আনাসরুল্লাহ সদস্যদের টার্গেট নির্ধারণ ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন তিনি।

সিটিটিসির উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেন, মামলার পর আগামীকাল (আজ) রানাকে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড চাওয়া হবে। তার কাছ থেকে হয়তো জঙ্গিবাদের অনেক তথ্যই উদ্ঘাটন করা সম্ভব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর