বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

নিখোঁজ রহস্যে পাঁচ যুবক

খোঁজ মেলেনি তিন মাসেও, জঙ্গি কানেকশন কিনা চলছে তদন্ত, সন্ধানে মাঠে র‌্যাব

সাখাওয়াত কাওসার

নিখোঁজ রহস্যে পাঁচ যুবক

জায়েন হোসেন খান পাভেল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ সেমিস্টারের ছাত্র। ১ ডিসেম্বর বনানী থেকে পাভেলসহ চারজন এবং ৫ ডিসেম্বর কলাবাগান থেকে সাইদ আনোয়ার খান নামে অন্য এক যুবক রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। বাবা-মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড় পাভেল। তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তার পরিবারের সদস্যরা মুষড়ে পড়েছেন। গতকাল এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন পাভেলের বাবা মো. রাসেল খান। তিনি বলছিলেন, ‘আমার তিন ছেলের মধ্যে বড় পাভেল। ও নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আমার অন্য ছেলেরাও স্কুলে যাচ্ছে না। আমি এবং ওর মা প্রায় সময়ই অসুস্থ থাকি। প্রেসার, ডায়াবেটিস সবকিছুই আনকন্ট্রোল হয়ে গেছে। আমার ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আমি কোথাও শান্তি পাচ্ছি না। বাসায় বিষ এনে রেখেছি। আর সহ্য করতে পারছি না। জানি না কখন কী হয়!’ প্রায় তিন মাসেও সন্ধান মেলেনি এই পাঁচ যুবকের। পাভেলের মতো নিখোঁজ অন্য যুবকদের পরিবারের অবস্থাও একই রকম। প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সহায়তা চাওয়া হলেও গতকাল পর্যন্ত তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে তাদের অবস্থান কোথায়, নিখোঁজ যুবকরা দেশ ছেড়েছেন কিনা এমন তথ্যও নেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে। তবে গোয়েন্দারা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছেন সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেফতার রেজওয়ানুল আজাদ রানার কাছে এসব যুবকের কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) কাছে পাঁচ দিনের রিমান্ডে থাকা রানাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানা গেছে।

সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই পাঁচ যুবকের ব্যাপারে আমরা বিভিন্ন কর্নার থেকে খোঁজ নিচ্ছি। তারা আত্মগোপনে রয়েছেন, নাকি কেউ তাদের তুলে নিয়ে গেছে এ বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।’

জানা গেছে, গত বছরের ১ ডিসেম্বর বনানী থেকে একযোগে চার তরুণ নিখোঁজ হন। তারা হলেন সাফায়েত হোসেন, জায়েন হোসেন খান পাভেল, মো. সুজন ও মেহেদী। এদের মধ্যে সাফায়েত ও  পাভেল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, চারজনের একযোগে নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক। নিখোঁজ চারজনের মধ্যে সাফায়েতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইল ঘেঁটে জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়ে সন্দেহ করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। একযোগে নিখোঁজ চার তরুণের একজন সুজনের ভাই সুমন জানান, ‘আমার ভাইয়ের চিন্তায় আমার মা শয্যাশায়ী। সুজন তো ঈদের নামাজও পড়ত না। কারও সঙ্গে কোনো ধরনের শত্রুতাও ছিল না। কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে তাও না।’ জানা গেছে, সুজনদের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে। বাবা আনিছুর রহমান। বর্তমানে পরিবার নিয়ে থাকেন খিলক্ষেতে। বনানী ৭ নম্বর রোডে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরি করতেন সুজন। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস্) কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিখোঁজদের নিয়ে এক ধরনের টেনশন কাজ করে। এটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রেখেই তাদের সন্ধান পেতে অভিযান চালানো হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অতীতে অনেক ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে আমরা দেখেছি অনেক ব্যক্তি নিজেরাই আত্মগোপনে ছিলেন। অনেককে অপহরণও করা হয়েছিল।’ কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অন্য এক কর্মকর্তা জানান, অনেক সময় জঙ্গিদের ভাষায় ফিদায়ি হওয়া বা হিজরত করার আগ পর্যন্ত তারা নিজেদের জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের বুঝতে দেয় না। এ কারণে তারা ধর্মীয় অনুশাসনও যথাযথভাবে পালন করে না। একযোগে চার তরুণ নিখোঁজের ক্ষেত্রে সাফায়েতের মাধ্যমে বাকি তিন তরুণ ‘মটিভেটেড’ হতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন। নিখোঁজ মেহেদীর চাচা মাহবুব হাওলাদার বলেন, চারটা ছেলে কোথায় গেল কেউ খুঁজে বের করতে পারছে না। তারা তো এক দিনের মধ্যে দেশ ছেড়ে যায়নি। তাদের পাসপোর্টও নেই। তাহলে কেন খুঁজে বের করা যাচ্ছে না? তিনি আরও বলেন, ‘যদি ওরা স্বেচ্ছায় কোনো ভুল পথে গিয়ে থাকে তবু তো ওদের দ্রুত খুঁজে বের করা উচিত। এরপর আইনি প্রক্রিয়ায় যা করার করবে। এতে পরিবারের সদস্যরাও শান্তি পাবে যে, ছেলে ভুল করেছে তার শাস্তি পাচ্ছে। কিন্তু এসবের কিছুই তো দেখছি না।’

৫ ডিসেম্বর সাইদ আনোয়ার খান নামে বনানীর আরেক তরুণ নিখোঁজ হয়। ‘ও লেভেল’ সম্পন্ন করা এই তরুণ কলাবাগানে একটি ক্যারাতে প্রতিযোগিতায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শেষে আর বাসায় ফেরেননি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, নিখোঁজ সাইদের জীবনাচরণে তারা ‘সন্দেহজনক’ কিছু তথ্য পেয়েছেন। এসব সূত্র ধরেই তার অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। সাইদের পরিবারের সদস্যরা জানান, নিখোঁজের পর থেকেই সাইদের বাবা-মা ভেঙে পড়েছেন। তারা ছেলেকে উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছিলেন তৎকালীন র‌্যাব-১-এর (বর্তমানে র‌্যাব-৩) অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ। গতকাল তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিভিন্ন কর্নার থেকে জানা গেছে প্যালেস্টাইন নিয়ে আগ্রহ ছিল সাইদের। তবে সে দেশ ত্যাগ করেছে এমন তথ্যও আমরা পাইনি।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর