রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
বিডিআর হত্যাযজ্ঞের ৮ বছর

চোখের জলে স্মরণ

মাহবুব মমতাজী

চোখের জলে স্মরণ

ছলছল চোখে হারানো স্বজনটির কথাই বলছিলেন। নির্বাক হয়ে শুনছিল অবুঝ শিশুটি। বনানী কবরস্থান থেকে গতকাল তোলা ছবি। —রোহেত রাজীব

কেউ হারিয়েছেন প্রিয় বাবাকে, কেউ প্রিয় সন্তান কিংবা স্বামীকে। পিলখানার সেই পৈশাচিক ঘটনার নির্মম স্মৃতি এখনো কুরে কুরে খাচ্ছে তাদের। হয়তো আমৃত্যু সেই বেদনা বয়ে বেঁচে থাকতে হবে নিহতদের স্বজনদের। পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনরা সেই শোক ও হাহাকার নিয়ে গতকাল শহীদদের স্মরণ করেছেন। বনানীর সেনা কবরস্থানে শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তারা। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডির এগারো দিনের মাথায় পৃথিবীর আলো দেখেছিল সাদাকাত সাবরি বিন মমিন। বাবা মেজর মো. মমিনুল ইসলাম সরকার তার ফুটফুটে মায়াবি চেহারাখানা না দেখেই চলে যান না ফেরার দেশে। পরে স্বামীর পছন্দেই সন্তানের নাম সাদাকাত রাখেন সানজানা সোনিয়া। জন্মের পর ৮ বছর ধরে এদিনে বাবার কবরের পাশে এসে দাঁড়ায় সাদাকাত। কিন্তু সে তার বাবাকে দেখে না, কাছে গেলেও তার সঙ্গে কথা হয় না তার বাবার।

গতকাল সকালে মা-ফুফু ও খালা-খালুদের সঙ্গে বনানীর সেনা কবরস্থানে বাবার স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যান শিশু সাদাকাত। পরে তার বাবার রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া করেন পরিবারের সদস্যরা। সাদাকাত তার মায়ের সঙ্গে মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে থাকে। জন উইলসন স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। বাবার কবরে শ্রদ্ধা জানানো শেষে সাদাকাত জানায়, আমার আব্বুকে আমি দেখিইনি। আমার ‘সাদাকাত’ নামটি আব্বুই ঠিক করে গিয়েছিল। আর আমি ভীষণ মিস করছি আব্বুকে। বড় হলে আমিও আব্বুর মতোই সেনা অফিসার হব। সাদাকাতের মা সানজানা সোনিয়া জানান, সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পর তার বাবার জীবন্ত মুখ চেনাতে না পারাটা যে কতটা কষ্টের তা কজনই বা বোঝে। প্রতিটা দিন বুকের মধ্যে পাথর চাপা দিয়ে ছেলেকে তিলে তিলে বড় করছি। আগামী ৭ মার্চ ৮ বছর পূর্ণ করবে সাদাকাত। আর বিয়ের দেড় বছরের মাথায় স্বামীকে চিরদিনের জন্য হারান ফারজানা আফরিন। তিনি পিলখানায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে বিডিআরের একমাত্র নিহত সৈনিক জহির ইসলামের স্ত্রী। ফারজানা বর্তমানে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে রসায়ন বিভাগে মাস্টার্সে পড়াশোনা করছেন। কুমিল্লা থেকে বাবার সঙ্গে স্বামীর কবরে শ্রদ্ধা জানাতে এসে ফারজানা এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার স্বামীর ইচ্ছা ছিল আমাকে মেডিকেলে পড়াবে। পিলখানার ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়েও আমি সেই ইচ্ছাই ব্যক্ত করেছিলাম। কিন্তু সে বিষয়ে পরবর্তীতে আর কেউই কোনো খোঁজ রাখেননি। অন্য শহীদ পরিবার যেমন সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন, আমরা তেমন পাইনি। এ সময় তিনি হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেন। এরপরে একে একে প্রতিটি শহীদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তাদের স্বজনরা। প্রত্যেকেই প্রিয়জন হারানোর বেদনা তুলে ধরেছেন। এর আগে সকাল সোয়া ৯টার দিকে প্রথমে শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মো. সরোয়ার হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বীর বিক্রম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ, বিমান বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, স্বরাষ্ট্র সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহম্মেদ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন। পরে জাতীয় পার্টির পক্ষে ফুল দেন দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দলের (পিএনপি) চেয়ারম্যান ফিরোজ মোহাম্মদ লিটন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস ও ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট। ফুল দেওয়ার পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, সেদিন যারা বর্বরোচিত পৈশাচিক ঘটনাটি ঘটিয়েছিল তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। আর যারা পেছন থেকে ইন্ধন যুগিয়েছে তাদেরকেও আনা হয়েছে। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বলেন, বিজিবির গোয়েন্দা কার্যক্রম শক্তিশালী করতে সরকারি সিদ্ধান্তের অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চারটি সেক্টরে ভাগ করে এই কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। বিএনপির পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান, সাবেক সেনাপ্রধান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। দিনটি উপলক্ষে বিএনপি নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচ তলায় এক বিশেষ দোয়ার আয়োজন করেছে। বিজিবি সদর দফতর পিলখানায় সব রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটকে নিয়ে বাদ ফজর খতমে কোরআন, বিজিবির সব মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। আজ রবিবার বাদ আসর পিলখানায় বীর উত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার মিলনায়তনে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব, বিজিবি মহাপরিচালক, শহীদদের স্বজনরা উপস্থিত থাকবেন।

সর্বশেষ খবর