শিরোনাম
বুধবার, ৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাংবাদিক দীপঙ্কর হত্যার কথা স্বীকার জঙ্গি রাজীবের

নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া

এক যুগ পর বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সহসভাপতি ও স্থানীয় দৈনিক দুর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী হত্যার রহস্য উদঘাটন হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। ঢাকার হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার আসামি শীর্ষ জেএমবি নেতা জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী বগুড়ার আদালতে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। গতকাল বগুড়া পুলিশ সুপারের কনফারেন্স রুমে ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান বলেন, হলি আর্টিজান হামলার আসামি রাজিব গান্ধী রিমান্ডে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, জেএমবি শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানের জামাতা শায়খ আবদুল আউয়ালের নির্দেশে সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে হত্যা করা হয়। দীপঙ্কর চক্রবর্তী জেএমবি ও বাংলা ভাই নিয়ে লেখালেখির কারণে তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। হত্যাকাণ্ডে রাজীব গান্ধীসহ আরও ৩ জন অংশগ্রহণ করে। এরা মানিক, সানাউল্লা এবং নুরুল্লাহ। বগুড়ার জহুরুলনগরে একটি মেসে বসে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। হত্যার আগের রাত ১০টায় মানিক মোটরসাইকেল দিয়ে সানাউল্লা ও নুরুল্লাহকে নিয়ে শেরপুরে যায়। এর আগে বাসে সেখানে পৌঁছে রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধীর দায়িত্বে ছিল গতিবিধি লক্ষ্য করা, আর হত্যার দায়িত্ব ছিল সানাউল্লা ও নুরুল্লাহ। রাত ১২ টায় বগুড়া থেকে কাজ শেষে সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী শেরপুরে নেমে একটি হোটেলে চা খান। পরে বাসায় যাওয়ার পথে বাসার সামনে তাকে হত্যা করা হয়। পুলিশ সুপার আরও জানান, সাংবাদিক নেতা দীপঙ্কর চক্রবর্তী গত ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর রাতে শেরপুর উপজেলার সান্যালপাড়ায় নিজ বাড়ির সামনে নির্মমভাবে অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতকারীরা হত্যা করে। হত্যাকারীরা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার দেহ থেকে মাথাকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। ঘটনার পরপরই দীপঙ্কর চক্রবর্তীর ছেলে সারথী চক্রবর্তী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। মামলাটি প্রথমে শেরপুর থানা পুলিশ তদন্ত করে। পরবর্তীতে তদন্তভার সিআইডি ২০০৭ সালের ২৬ নভেম্বর বিজ্ঞ আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেছিল। এরপর বাদী নারাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি পুনরায় তদন্তের আদেশ হয় এবং তদন্তভার পুনরায় বিজ্ঞ আদালত সিআইডিকে নির্দেশ দেয়। এরপর সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুস সামাদ মিঞা ২০১৩ সালের ১৩ জুলাই আবারও চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য বলে দাখিল করেন। বাদীর পুনরায় নারাজি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির তদন্তভার ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বগুড়ার ওপর দায়িত্ব প্রদান করে। তিনি আরও জানান, ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে নাছির ওরফে রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাস ওরফে জাহিদ ওরফে জাকির ওরফে আদিল ওরফে টাইগার ওরফে আবু ওমর আল বাঙ্গালকে (৩৩) গ্রেফতারের পর বগুড়া জেলার শেরপুর থানা পুলিশ জোয়ানপুরের জেএমবি আস্তানায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ড নেওয়া হয়। তাকে নিবিড় এবং ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে রাজীব গান্ধী ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। সে জানায়, ২০০১ সালে জেএমবিতে যোগদান করে এবং ২০০৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে সারোয়ার জাহান ওরফে মানিক তাকে হিজরত করতে বলে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থেকে সিরাজগঞ্জ জেলায় ডা. নজরুলের নিকট যায়। ডা. নজরুল তাকে একটি মেসে নিয়ে যায়। সেখানে শাহাদত, মানিকসহ ৫/৬ জনকে দেখতে পায়। প্রায় ২ মাস মেসে অবস্থান করেছিল। একদিন মানিক রাজীব গান্ধীকে বলে বগুড়ায় একটা কাজ করতে হবে। রাজীব গান্ধী তাতে রাজি হওয়ায় ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে মানিক তাকে সিরাজগঞ্জ হতে বগুড়া জহুরুল নগর এলাকায় ভাইবোন ছাত্রাবাসে নিয়ে আসে। ওই মেসে সে নুরুল্লাহ, সানাউল্লা, রাহাত, শিহাব, ওসমানসহ মোট ১০/১২ জনকে দেখতে পায়। মেসে ৩টি রুম ছিল তার মধ্যে একটি রুম ফাঁকা ছিল। তারা ২ জন রাতে ওই মেসে অবস্থান করে। পরের দিন সকাল ১০ টায় আবদুল আওয়াল ওই মেসে এক ব্যক্তিসহ আসে এবং সেখানে একটি মিটিং হয়। মিটিংয়ে আবদুল আওয়াল আলোচনা করে যে, জেএমবি সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি এবং বিভিন্ন মিটিংয়ে জেএমবি কার্যক্রম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় সুরা সদস্য সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই দুর্জয় বাংলার সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে এবং সেখানে শায়খ আবদুল আওয়াল সাংবাদিককে হত্যার বিস্তারিত পরিকল্পনা করে। সেই সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, নুরুল্লাহ, সানাউল্লা এবং মানিক মিলে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। পুলিশ সুপার আরও জানান, মামলা সূত্রে জানা যায়, সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর রাতে বাড়ির গেটের সামনে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে। ২০০৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মামলাটি থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশ, সিআইডি পুলিশের ১২জন কর্মকর্তা তদন্ত করেছে। ২০১২ সালে সিআইডি পুলিশ বগুড়ার চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলাটির চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয়। এরপর বাদী নিহতের ছেলে পার্থ সারথী চক্রবর্তীর না-রাজি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক দফা শুনানির পর বগুড়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ২০১৪ সালে মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন। নির্দেশনা অনুসারে ১২নং তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে ডিবির এসআই মজিবর রহমান সেটি তদন্ত করছেন। মামলাটি ক্লু-লেস বলে আদালতে চার বার চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়। তবে, রিপোর্টে বলা হয়, হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত ছিল।

সর্বশেষ খবর