বুধবার, ৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

স্বাধীন বাঙালি জাতির উত্থান

হাসানুল হক ইনু

স্বাধীন বাঙালি জাতির উত্থান

মার্চ ’৭১ স্বাধীনতার মাস এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মাস। আমার কাজ ছিল জয় বাংলা বাহিনীকে সশস্ত্র করা, সামরিক কায়দায় দক্ষ করে তোলা। আমার তৎকালীন নেতা হিসেবে সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলামের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে কাজ করতাম। ইয়াহিয়া খান যখন গণপরিষদ বাতিলের ঘোষণা দেন, তখন তাত্ক্ষণিকভাবে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে যে ছাত্র-যুব সমাবেশ হয়, সেখানে আ স ম আবদুর রব স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। প্রয়াত শেখ জাহিদ হোসেন এবং আওয়ামী লীগের খিলগাঁওয়ের কর্মী ইদু এ পতাকা নিয়ে জনসভায় আসেন। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। বঙ্গবন্ধু কীভাবে পূর্বাণী হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সমগ্র ইশতেহার পাঠ শোনেন এবং আশীর্বাদ করেন। বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ হয়ে গেল। বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা করা হলো। বাংলাদেশের পতাকা যা ২ তারিখে ওড়ানো হয়েছিল সেই পতাকাকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে চূড়ান্ত করা হলো। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হলো। জাতীয় সংগীতও চূড়ান্ত করা হলো। আমার চোখের সামনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের ঘটনা, জাতীয় সংগীত নির্ধারণের ঘটনা, বঙ্গবন্ধু অপূর্ব কায়দায় অসহযোগ আন্দোলনের আড়ালে বাংলাদেশকে একটি স্বশাসিত বাংলাদেশে রূপান্তরিত করলেন। ৮ মার্চ থেকে সব কর্তৃত্ব বঙ্গবন্ধুর হাতে চলে যায় এবং আদেশ ও নির্দেশের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব উনি নিলেন। সুতরাং ৮ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করল। আমি ২৩ মার্চের আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনারও সাক্ষী। সেদিন ছিল পাকিস্তান রিপাবলিক ডে। সেই প্রজাতন্ত্র দিবসে পাকিস্তানে ছুটি থাকত। সেদিন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করে। এ কর্মসূচি হিসেবে সারা বাংলাদেশে জয় বাংলা বাহিনী সামরিক কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলনের কাজ হাতে নেয়। ঢাকা শহরের পল্টন ময়দানে সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ হয়। প্রায় হাজার তিনেক ছেলেমেয়ে জয় বাংলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে সামরিক কায়দায় রাইফেল হাতে কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন অভিবাদন গ্রহণ করেন। মঞ্চে তাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কামালউদ্দিন (পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূত) এবং মহানগর ছাত্রলীগ সভাপতি মনিরুল হকও ছিলেন। কামরুল আহসান খান খসরু সামরিক কায়দায় বন্দুক উঁচিয়ে সালাম ও অভিবাদন দেন। আমি পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে বাংলাদেশের পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে ২৩ মার্চ পল্টন ময়দানে উত্তোলন করি। ২৩ মার্চ হচ্ছে সেই দিন, যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা সর্বত্র উত্তোলন করা হয়েছিল এবং সেই দিনই পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছিল। ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী ক্র্যাকডাউন করল। এর আগে থেকেই আমি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে গোলাবারুদ সংগ্রহের কাজে লিপ্ত ছিলাম। মার্চজুড়ে আমরা আমাদের উদ্ভাবিত গ্রেনেডের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতাম। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গ্রেনেড উৎপাদনের একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতেন প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশিষ্ট সাংবাদিক মাসুদ আহমেদ রুমী, বাসদ নেতা মাহবুবুল হকসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা আক্রমণ চালাল, স্বাধীন বাংলাদেশ দখল করার জন্য। একটা নিরস্ত্র জাতি সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে ঢুকে গেল। নিরস্ত্র জাতি সশস্ত্র জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছে ১৯৭১-এর মার্চে।

হাসানুল হক ইনু : জাসদ সভাপতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রী।

অনুলিখন : নিজামুল হক বিপুল।

সর্বশেষ খবর