সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

সিঙ্গেল অ্যাটাকে জঙ্গিরা

আশকোনায় আত্মঘাতী যুবকটি কে, ঢামেক মর্গে লাশখিলগাঁওয়ের ঘটনায় মামলা

মির্জা মেহেদী তমাল

চট্টগ্রামের ছেলে নিয়াজ মোরশেদ রাজা। যিনি সিরিয়ায় গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন আইএসে। তার সাংগঠনিক নাম আবু মরিয়ম আল বাঙ্গালী। ২০১৫ সালের ১২ অক্টোবর ইরাকের তিকরিত শহরে ‘গাড়ি বোমা’ নিয়ে আত্মঘাতী হন তিনি। আত্মঘাতী হওয়ার আগে তিনি তাদের অনুসারীদের লক্ষ্যবস্তুতে ‘সিঙ্গেল অ্যাটাক’র আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। আশকোনা র‍্যাবের নির্মাণাধীন সদর দফতরে আত্মঘাতী হামলাটি ‘সিঙ্গেল অ্যাটাক’ বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। তাদের আশঙ্কা, নিয়াজ মোরশেদ রাজা ওরফে আবু মরিয়ম আল বাঙ্গালীর সেই আহ্বানেই জঙ্গিরা আত্মঘাতী হামলার কৌশল পাল্টেছে। একাধিক ব্যক্তির বদলে ‘সিঙ্গেল অ্যাটাক’ শুরু করেছে। আত্মঘাতীর এই নতুন কৌশল ভাবিয়ে তুলেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। খিলগাঁওয়ে র‍্যাবের চেকপোস্টেও আত্মঘাতী হামলাকারীর সংখ্যা ছিল এক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জঙ্গিদের হামলার নতুন এই কৌশল ভয়ঙ্কর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে ‘সিঙ্গেল অ্যাটাক’ ঠেকানো কঠিন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, বিশ্বজুড়েই জঙ্গি হামলার গতি প্রকৃতি পাল্টে যাচ্ছে। বর্তমানে ‘সিঙ্গেল অ্যাটাক’র ঘটনা ঘটছে বেশি। বাংলাদেশের জঙ্গিরাও এই কৌশল বেছে নিয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর আহমদিয়া জামে মসজিদে ‘লোন উলফ’ হামলার ঘটনা ঘটেছিল। গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, ধারাবাহিক অভিযানের কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়া জঙ্গি সংগঠনগুলো নতুন  কৌশল অবলম্বন করছে। এ কারণে ‘সিঙ্গেল অ্যাটাকে’র মতো ভয়ঙ্কর হামলার পথ নিয়েছে। এদিকে পর পর দুটি ঘটনার পর আত্মঘাতী হামলা নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। সাধারণ মানুষ রয়েছেন উদ্বেগ উত্কণ্ঠায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ভাবিয়ে তুলেছে। এ পরিস্থিতিতে সারা দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, জঙ্গি দমনে সরকার জিরো টলারেন্সে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও জঙ্গি দমনে নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের আইজি জঙ্গি সম্পর্কে তথ্য দিতে জনসাধারণের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। জঙ্গি বিরোধী কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সিঙ্গেল অ্যাটাকের ধরন হলো-আত্মঘাতী ব্যক্তিকে কোনো গুলি ছুড়তে হয় না। যে কোনো ভাবেই লক্ষ্যবস্তু বা নিশানায় থাকা ব্যক্তির কাছাকাছি পৌঁছতে পারলেই সে সফল। কারণ সেখানে পৌঁছামাত্রই শরীরে বেঁধে রাখা ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’ বিস্ফোরণের মাধ্যমে সে আত্মঘাতী হয়। এ ধরনের হামলায় হামলাকারী জীবিত না থাকায় তার কাছ থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়া একা একা হামলা চালানোর কারণে তাকে সন্দেহ করা যায় না। এ ধরনের হামলা এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হচ্ছে। জঙ্গিদের নিয়ে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে জেরার মুখে নানা তথ্য দিয়েছে জঙ্গিরা। জেরার মুখে তারা বলেছে, পুলিশের ধারাবাহিক অভিযানের কারণে জঙ্গিদের দলবদ্ধ হয়ে কোনো আস্তানায় অবস্থান করা কিছুটা কঠিন হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েকটি আস্তানায় পুলিশের অভিযানের পর তারা নানা কৌশল নিয়েছে। তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে মেসেঞ্জার অ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়ে থাকে। এ কারণে একজন সিঙ্গেল অ্যাটাকার যে কোনো স্থানে থেকে গোপনে হামলার প্রস্তুতি নিতে পারে।

সুইসাইডাল ভেস্ট : সিঙ্গেল অ্যাটাকের হামলাকারী সুইসাইডাল ভেস্টের মাধ্যমে আত্মঘাতী হয়। গত বছর ডিসেম্বরে আশকোনায় হাজী ক্যাম্পের পাশের একটি বাড়িতে সুইসাইডাল ভেস্টের মাধ্যমে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় এক নারী জঙ্গি। ওই ঘটনার পর গত শুক্রবার ফের একই কায়দায় আত্মঘাতী হামলা চালাল এক জঙ্গি। পরদিন খিলগাঁওয়ে র‍্যাবের চেকপোস্টে নিহত আত্মঘাতীর শরীরেও ছিল এই ভেস্ট। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সুইসাইডাল ভেস্ট দেখতে ফতুয়া বা হাতা কাটা গেঞ্জির মতো। এটা বেল্টের মতোও হয়। যা জঙ্গি-সন্ত্রাসী আত্মঘাতী হামলা চালাতে ব্যবহার করে। এই পোশাক থাকে বিস্ফোরক ভর্তি। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মিরপুরের একটি জঙ্গি আস্তানা  থেকে কয়েকটি সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার করেছিল পুলিশ। 

আত্মঘাতী যুবকটি কে : রাজধানীর আশকোনায় নির্মাণাধীন র‍্যাব সদর দফতরে আত্মঘাতী হামলায় নিহত যুবকটি কে? গত তিন দিন ধরে লাশটি পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। শুরুতে পিরোজপুরের আমিরন বেগম নামে এক মহিলা আত্মাহুতি দেওয়া ওই যুবককে তার ছেলে দাবি করলেও পরবর্তীতে তিনি তার অবস্থান থেকে সরে আসেন। দ্বিতীয় দফায় নিহত ওই যুবক ফরিদপুরের ভাঙ্গার জুয়েল রানা- এ বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত করেই বলেছিলেন কয়েকটি সংস্থার সদস্যরা। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের (এনআইডি) ডাটাবেজের সঙ্গে নিহতের আঙ্গুলের ছাপ মিলে যাওয়ার পরই রাতে ফরিদপুর ভাঙ্গার গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয় জুয়েলের বাবা-মাসহ পরিবারের ৮ সদস্যকে। তবে জুয়েলের চাচা গতকাল বলেন, আমাদের পরিবারের ৮ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এটা সত্যি। আমরাও মনে করেছিলাম নিহত ওই যুবকই হয়তো জুয়েল। তবে গতকাল সকালে জুয়েলের ফোন আসায় আমরা চমকে গেছি। র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহ্মুদ খান জানান, প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিতের জন্য দুই লাশের ছবিই র‍্যাবের নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং ফেসবুকে আপলোড দেওয়া হবে। কেউ দাবি করলে লাশের সঙ্গে তার ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

 

সর্বশেষ খবর