শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
ট্রাফিক পুলিশে ভিডিও কেস

আইন ভঙ্গ হবে রাস্তায় নোটিস যাবে বাসায়

আলী আজম

রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডে গ্রামীণফোন সেন্টারের সামনে প্রাইভেট কার রেখে ব্যক্তিগত কাজে যান বুয়েটের সাবেক উপ-উপাচার্য ড. নুরুদ্দিন আহমেদ। কাজ শেষে তিনি বাসায় ফেরেন। ঘটনার সাত দিন পর তার ঠিকানায় ট্রাফিক পুলিশের পশ্চিম বিভাগ থেকে একটি নোটিস পাঠানো হয়। এতে তিনি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেছেন বলে জানানো হয়। নোটিসে নির্দিষ্ট তারিখে তাকে ট্রাফিক কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়।

চলতি মাসের শুরুর এ ঘটনায় গতকাল তিনি ট্রাফিক পুলিশের পশ্চিম বিভাগে হাজির হন। ড. নুরুদ্দিন আহমেদ জানান, আগে রং পার্কিং করা হলে ট্রাফিক পুলিশ গাড়ির একটি চাকা লক করে দিত। বর্তমানে সেটা না করে প্রমাণ হিসেবে ভিডিও করা হচ্ছে। পরবর্তীতে গাড়ির মালিককে আইন ভঙ্গের বিষয়টি জানানো হচ্ছে। যা গাড়ির মালিক জানতেনই না। এটা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আমি এ পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই।

রাজধানীতে তার মতো অনেক গাড়ির মালিককেই সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক কার্যালয়ে হাজির হতে হয়েছে। দিতে হয়েছে জরিমানা। ট্রাফিক পুলিশ বলছে, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে উল্টো পথে চলাচল, সিগন্যাল অমান্য ও যত্রতত্রভাবে পার্কিং করলেই ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দেখে গাড়ির মালিকের বাসায় নোটিস পাঠানো হবে। দিতে হবে জরিমানা। অস্বীকার করলে দেখানো হবে প্রমাণ হিসেবে তুলে রাখা ভিডিও ফুটেজ। উন্নত দেশগুলোতে এর প্রয়োগ থাকলেও বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এই সেবা চালু করল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া এ পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ভিডিও কেস বা সচিত্র মামলা। পরীক্ষামূলকভাবে ২০১৪ সালের শেষের দিকে ট্রাফিকের পশ্চিম বিভাগে এ সেবা চালু করা হয়। পরে ট্রাফিক উত্তর বিভাগে এক কার্যক্রম বিস্তৃত করা হয়। চলতি বছরের শুরুতেই ট্রাফিকের দক্ষিণ ও পূর্ব বিভাগে এ সেবা চালুর মধ্য দিয়ে ডিএমপিতে পূর্ণাঙ্গভাবে ভিডিও কেস বা সচিত্র মামলার কার্যক্রম শুরু করে।

ট্রাফিক পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগ জানুয়ারিতে ১৩২, ফেব্রুয়ারিতে ২১১ এবং মার্চে ২৫১টি; ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগ জানুয়ারিতে ৩৮১, ফেব্রুয়ারিতে ৫৭১, মার্চে ৬৯৪টি; ট্রাফিক পূর্ব বিভাগ জানুয়ারিতে ১৫, ফেব্রুয়ারিতে ২৫, মার্চে ২৫টি নোটিস ইস্যু করে। তবে ট্রাফিক উত্তর বিভাগের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সচিত্র মামলার বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশের পশ্চিম বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) লিটন কুমার সাহা জানান, ট্রাফিক পুলিশে নতুন এ সেবা বেশ কাজে দিচ্ছে। এ সেবা চালুর পর থেকে গাড়িচালকদের মধ্যে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার হয়েছে। আর এ ভীতির কারণেই চালকদের মধ্যে আইন ভঙ্গের প্রবণতা কমে এসেছে। ট্রাফিক পুলিশ বলছে, এ সেবার আওতায় প্রতিটি ট্রাফিক বিভাগে একটি করে টিম রয়েছে। টিমে একজন অফিসার এবং তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে আরও ছয়জন ট্রাফিক সদস্য। রুটিন করে ভিডিও টিমগুলো একেক দিন একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবস্থান করে। এসব টিম উল্টো পথে চলাচল, সিগন্যাল অমান্য এবং যত্রতত্র পার্ক করে রাখা গাড়ির ভিডিও চিত্র ধারণ করে। পরে ওই ভিডিও চিত্র থেকে গাড়ির নম্বর সংগ্রহ করে পাঠানো হয় বিআরটিএতে। সেখান থেকে গাড়ির মালিকের ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়। পরে গাড়ির মালিকের বাসায় একটি নোটিস পাঠিয়ে তাকে এক সপ্তাহের মধ্যে ট্রাফিকের সংশ্লিষ্ট ডিসি কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়। ট্রাফিক পুলিশ উত্তরের মহাখালী জোনের এসি আশরাফউল্লাহ বলেন, কয়েকটি গাড়ি রং পার্কিং করেছে। বিষয়টি টের পেয়ে ট্রাফিক পুলিশ সেখানে হানা দেয়। একটি গাড়িকে মামলা করতেই অন্যগুলো পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া গাড়িগুলো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বা মোবাইল ক্যামেরার মাধ্যমে চিহ্নিত করে গাড়ির মালিকের বাসায় নোটিস পাঠানো হয়। এভাবে উল্টো চললে বা সিগন্যাল অমান্য করলে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এই ভিডিও কেস বা সচিত্র মামলা বেশ কাজে দিচ্ছে। গাড়ির চালকদের মধ্যে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের প্রবণতা কমছে।

ট্রাফিক পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের ডিসি রিফাত রহমান শামীম জানান, ট্রাফিক দক্ষিণে ৪/৫ মাস ধরে সচিত্র মামলার কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এই কার্যক্রম চালুর ফলে আইন ভাঙার প্রবণতা কমেছে। বর্তমানে সচিত্র মামলা পুরোটাই ডিজিটাল। ফলে কোনো তদবির বা কারও সুপারিশ গ্রহণের সুযোগ থাকছে না। ট্রাফিক পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলছেন, ট্রাফিক আইন ভাঙা রোধে উন্নত দেশগুলোয় সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগিয়ে আইন ভঙ্গ করা গাড়ির ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয়। পরে ওইসব গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমরাও সে ফর্মুলায় কাজ করছি। ফলাফলও ভালো। দুর্ঘটনা রোধ করে যানবাহন ও জনগণের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে প্রাথমিকভাবে ম্যানুয়ালি ভিডিও সংগ্রহ করা হচ্ছে। পরবর্তীতে আমরাও চেষ্টা করব গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারসেকশনে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করে ভিডিও কেইস করার। এতে একদিকে যেমন আইন ভঙ্গ করার প্রবণতা কমবে তেমনই হ্রাস পাবে প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানোর প্রবণতাও। ট্রাফিক পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে যান চলাচল স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য ১০০টি গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারসেকশন চিহ্নিত করে ৯২টিতে অটোমেটিক এবং রিপোর্ট কন্ট্রোল নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সিএএসই (ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইন্যাবল ইনভারমেন্ট) প্রকল্পের আওতায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ট্রাফিক সিগন্যাল অনুযায়ী যানবাহন চলাচলের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু এই প্রকল্প পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন হলে অটোমেটিক পদ্ধতিতে ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করবে ডিএমপি। আর এ কারণে ইতিমধ্যে রাজধানীর ট্রাফিক সিগন্যাল সিস্টেমের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারের সমন্বয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে একটি নতুন ইউনিট গঠন প্রক্রিয়াধীন। এর আগে, ২০১৪ সালের ২৩ মে হেয়ার রোডে ট্রাফিক পুলিশের দক্ষিণ বিভাগ উল্টো পথে গাড়ি থামাতে প্রতিরোধক যন্ত্র বসিয়েছিল। একই বছরের ২২ নভেম্বর ডিএমপি সদর দফতরের সামনের সড়কে ওই প্রতিরোধক যন্ত্রটি বসানো হয়। অ্যানালগ এই যন্ত্রটি উল্টো পথে গাড়ি গেলেই চাকা ফুটো করে দিতো। প্রাথমিক পর্যায়ে সেটা ভালো কাজ দিলেও পরে তা নষ্ট হওয়ায় এ মিশন ব্যর্থ হয়।

সর্বশেষ খবর