সোমবার, ১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

আন্দোলনের হুমকি ব্যবসায়ীদের দমনের হুঁশিয়ারি অর্থমন্ত্রীর

১৫ শতাংশ ভ্যাট নিয়ে বাকবিতণ্ডা

নিজস্ব প্রতিবেদক

নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ালেন ব্যবসায়ীরা। তারা ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হলে রাজপথে আন্দোলনের হুমকি দেন। জবাবে ব্যবসায়ীদের আন্দোলন দমনের হুঁশিয়ারি দেন অর্থমন্ত্রী। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর চেয়ারম্যান ব্যবসায়ীদের যে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছেন, তারও কড়া জবাব দিয়েছেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর প্রথম সহসভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।

গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র-বিআইসিসিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর এবং বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই যৌথভাবে আয়োজিত পরামর্শক কমিটির ৩৮তম সভায় এ বাকবিতণ্ডা হয়।

এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে পরামর্শক কমিটির সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ।

ওই সভায় মুক্ত আলোচনা পর্বে নতুন মূল্য সংযোজন কর- মূসক বা ভ্যাট আইনের অসঙ্গতি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সংগঠন ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও এফবিবিসিআই পরিচালক আবু মোতালেব অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে যাদের টার্নওভার বছরে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত, তাদের টার্নওভার কর ৩ শতাংশ নির্ধারণ করে ব্যবসা করার সুযোগ  দিন। নতুবা দেশীয় পণ্য ও শিল্প বাঁচবে না। তিনি বলেন, মাঝারি পর্যায়ে প্যাকেজ ভ্যাট সীমা তিন কোটি টাকা পর্যন্ত নির্ধারণের দাবি করছি। খুচরা পর্যায়ে প্যাকেজ ভ্যাট সুবিধা প্রদানের বিষয়টি এ বাজেটে পুনর্বিবেচনা করুন। এফবিসিসিআই ভ্যাট নিয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা যদি না মানেন, তাহলে ব্যবসায়ীরা ছাত্রদের মতো রাস্তায় নামবেন। আবার এই আইন মুখ থুবড়ে পড়বে। এ সময়ে আবু মোতালেবের বক্তব্য থামিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, অনেক বলেছেন, এবার থামুন। আপনি খামাখা আন্দোলন করেন। আন্দোলন করে কিছু হবে না। আন্দোলন আমরা দমন করব। ভোগাস কথাবার্তা বলেন। এক পয়সার ট্যাক্স দেন, মোটা মোটা কথা বলেন। অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর ওই সভায় উপস্থিত ব্যবসায়ীরা তীব্র আপত্তি তোলেন। তারা অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি করে হৈচৈ করেন। এ সময়ে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানান। নজিবুর রহমান বলেন, আমরা একটা খারাপ উদাহরণ তৈরি করছি। তিনি ব্যবসায়ীদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানালেও তারা অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে অনেকক্ষণ হৈচৈ করেন। এ সময়ে ব্যবসায়ীদের শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এফবিসিসিআইর প্রথম সহ-সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আমরা এখানে আলোচনা করছি। অর্থমন্ত্রী ও এনবিআরের সঙ্গে আমাদের সংলাপ চলমান আছে। আমরা এখনো বাজেট দেখিনি। আমরা আশা করছি, সরকার কোনো কিছু চাপিয়ে দেবে না। এটা শেখ হাসিনার সরকার। বাজেট ব্যবসাবান্ধব হবে, আমরা এটাই প্রত্যাশা করি। পরে প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদানকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আবু মোতালেব থ্রেট (হুমকি) দিয়েছেন। এ বক্তব্যটা আমার মোটেই পচ্ছন্দ হয়নি। এটা আলোচনার মধ্যে পড়েনি। এটা একটা যুদ্ধ পর্ব। এখানে যুদ্ধের থ্রেট করা প্রচণ্ড অন্যায়। এটা প্রত্যাহার করা উচিত। এর আগে এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে এনবিআর ও এফবিসিসিআই সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমিটির ৭ দফা সুপারিশ এবং ওয়ার্কিং কমিটির যৌথ সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা নতুন ভ্যাট আইনের বিপক্ষে নয়, কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী আইনের সংশোধন করা না হলে তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাবে। তাই দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, ব্যবসা ও সেবা খাতের কর্মকাণ্ড যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য ভ্যাট আইন ও বিধি সংশোধন করা হোক। তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের স্বার্থে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট নির্ধারণের প্রস্তাব দেন। এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান ব্যবসায়ীদের প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে বলেন, এখানকার আপনারা কে কী করেন, সবার নাড়ি-নক্ষত্র আমার হাতে আছে। এজেন্সি আমাকে প্রতিদিন রিপোর্ট করে। নজিবুরের এ হুমকির কড়া জবাব দিয়ে এফবিসিসিআইর প্রথম সহ-সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আপনি এজেন্সির কথা বলে ব্যবসায়ীদের প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছেন। আপনাকেও মনে রাখতে হবে, এজেন্সিগুলো আমাদের সবার। এখানে একজন আরেকজনকে প্রতিপক্ষ ভাবার কারণ নেই। তাই বলছি— ব্যবসায়ীদের প্রতিপক্ষ মনে করলে এগোতে পারবেন না। আন্দোলন বা মানববন্ধন করা ব্যবসায়ীদের কাজ নয়। মিষ্টির দোকানদার ভ্যাট দেয় না এটা বলে সবাইকে উসকানি দেবেন না। এফবিসিসিআইর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, নতুন ভ্যাট আইনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। নতুন আইনে অনেক পণ্যে সম্পূরক শুল্ককর থাকবে না। সে ক্ষেত্রে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, দেশীয় শিল্প হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও বিদেশি পণ্যের সঙ্গে টিকতে পারছে না অসম বাণিজ্যের কারণে। বাজেটে বিষয়টির সুরাহা হবে বলে আশা করছি। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ভ্যাট প্রদান করেন ভোক্তারা। ভোক্তার দেওয়া ভ্যাট সরকারি কোষাগারে সঠিকভাবে যায় না। তাই ভ্যাট দেওয়ার পর ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করুন। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো উচিত বলেও মনে করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-বিডব্লিউসিসিআই সভাপতি সেলিমা আহমেদ বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদহারে এখন সিঙ্গেল ডিজিটি নেমে এসেছে। ভ্যাটেও সিঙ্গেল ডিজেট করা হোক। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আগামী অর্থবছরেও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হোক। ওই পরামর্শক কমিটির সভায় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-ডিসিসিআই সভাপতি আবুল কাশেম খান, সংগঠনটির সাবেক সভাপতি এম এ মোমেন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস-বেসিসের সভাপতি মোস্তাফা জব্বার, অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস বাংলাদেশ-অ্যামটবের মহাসচিব নুরুল কবির, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-সিএসসিসিআই সভাপতি খলিলুর রহমান, নারী উদ্যোক্তা সেলিনা কাদের প্রমুখ।

সর্বশেষ খবর