রবিবার, ২৮ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

কোণঠাসা নব্য আওয়ামী লীগাররা

অন্য দল থেকে আসা কারও সদস্যপদ নবায়ন নয়, কেন্দ্রের কথার বাস্তবায়ন চায় তৃণমূল

রফিকুল ইসলাম রনি

জীবনে কখনো ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগ করেননি। একদিনের জন্যও ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিতে দেখা যায়নি। তারা শুধু আওয়ামীবিরোধী রাজনীতিই করেননি, বরং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাদের ওপর চালিয়েছেন নির্যাতনের স্টিমরোলার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ওইসব নেতারা খোলস পাল্টে সরকার দলীয় সংগঠনে যোগদান শুরু করে। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সেই প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সারা দেশে কমপক্ষে লক্ষাধিক বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। এমপি-মন্ত্রীদের হাত ধরে তৃণমূলে গুরুত্বপূর্ণ পদও বাগিয়ে নিয়েছেন তারা। এসব নব্য লীগারদের কারণে এমপি-মন্ত্রীদের কাছে ভিড়তে পারেন না দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা। নতুন নতুন মুজিবকোট পরিহিত এরা ঘুরে বেড়ায় প্রশাসনে ও লোকালয়ে। দুই মেয়াদে অন্য দল থেকে  আসা প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক নেতা এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। ঘুরে বেড়ান নামি-দামি গাড়িতে। বসবাস করেন আলিশান বাড়িতে। তাদের কুকীর্তির কারণে দলকেও বিব্রত হতে হয়েছে বারবার। প্রভাবশালী নেতা-এমপি-মন্ত্রীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা এতদিন ভালো থাকলেও এবার কপাল পুড়তে যাচ্ছে তাদের। কারণ আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের স্পষ্ট ঘোষণা ‘যারা বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেছেন, তাদের সদস্যপদ নবায়ন করা হবে না।’ দলের শীর্ষ নেতাদের কথায় আশাবাদী হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল। অন্যদিকে ইতিমধ্যে কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে নব্য লীগারদের। যাদের হাত ধরে তারা ক্ষমতাসীন দলে প্রবেশ করেছিলেন সেই সব নেতাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তারা। দলীয় সূত্রমতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। গত ২০ মে গণভবনে এক বিশেষ বর্ধিত সভায় নিজের সদস্যপদ নবায়ন ও দুজনকে দলের নতুন সদস্য করে এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় দলে অনুপ্রবেশকারীদের ‘আবর্জনা’ উল্লেখ করে নেতা-এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে তথ্য আছে, গ্রুপিং ভারি করতে অন্য দল থেকে সুবিধাবাদীদের দলে টানা হচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মনে রাখবেন, এরা দলে ঢুকে কমিশন খাওয়ার লোভে। এরা তখন এত বেশি শক্তিশালী হয়ে যায় যে এদের কনুয়ের গুঁতায় আমার দলের নিবেদিতরা টিকতে পারে না। অন্য দলের লোক আওয়ামী লীগে দরকার নাই।’ গত বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে জেলা নেতাদের হাতে নতুন সদস্য সংগ্রহের ফরম বুঝিয়ে দেওয়ার সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করেন ‘যারা বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেছেন, তাদের সদস্যপদ নবায়ন করা হবে না।’ দলের গঠনতন্ত্রের ৫(১) ধারা অনুযায়ী, দলে যোগ দিতে হলে গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র মেনে প্রাথমিক সদস্য পদের জন্য আবেদন করতে হয়। সে আবেদনে দলের স্থানীয় ইউনিট সুপারিশ করলেই শুধু আগ্রহীদের দলে যোগদান করানো যেতে পারে; কিন্তু এ নিয়ম মানা হয়নি। তৃণমূল পর্যায়ে কমপক্ষে ২০টি জেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যারা কখনোই ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা জাতির জনকের আদর্শের কোনো সংগঠনে যুক্ত ছিলেন না, বরং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছেন, এখন তারা রাতারাতি ‘মুজিব সেনা’ হয়ে উঠেছেন। তাদের সাদরে বরণ করে নিচ্ছেন আওয়ামী লীগের একশ্রেণির এমপি-মন্ত্রী ও নেতা। নবাগতদের দলীয় পদ-পদবি কিংবা জনপ্রতিনিধির পদে বসিয়ে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের দেওয়া ‘ফুলের মালা’ গলায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ‘ছাতা’ পাওয়া নব্য এই আওয়ামী লীগাররা নানা অপকর্মে জড়িয়ে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই নব্য লীগারদের রাশ টেনে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের হাইকমান্ড। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যারাই অন্যদল থেকে আওয়ামী লীগে এসেছেন, তাদের কারও সদস্যপদ এবার নবায়ন করা হবে না। জেলা-মহানগর ও উপজেলা সভাপতি-সম্পাদকদের এমন নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। কেউ যদি কেন্দ্রের নির্দেশনা অমান্য করেন তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ব্যাপারে কেন্দ্র অত্যন্ত কঠিন ও সতর্ক। কেন্দ্রের ঘোষণার পর আশাবাদী হয়ে উঠছেন তৃণমূল আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা। তারা কেন্দ্রের কথার বাস্তবায়ন চান। এ প্রসঙ্গে গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ শামসুল আলম হিরু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সারা দেশেই এমপি-মন্ত্রীদের হাত ধরে দলে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে পড়ছে। গাইবান্ধা তার ব্যতিক্রম নয়। এমপি সাহেবরা নিজস্ব বলয় ভারি করতে জামায়াত-শিবির, বিএনপি নেতাদের দলে ভিড়িয়েছেন। দলীয় সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদকের ঘোষণার পর কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে দাবি জানাচ্ছি, উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে বর্ধিত সভা করে এসব অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে তাদের দল থেকে বাদ দেওয়া হোক। তা না হলে তাদের ধাক্কায় দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা দূরে সরে যাবে।’কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুল আহসান শাহজাহান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করার জন্য এমপিরা অন্য দলের নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগে স্থান দিয়েছেন। দলীয় সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদক যে নির্দেশনা দিয়েছেন, আমরা তা পালন করব।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে এমপি ও নেতা যত প্রভাবশালীই হোন না কেন অনুপ্রবেশকারীদের সদস্য পদ নবায়ন করতে দেওয়া হবে না। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আমির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিগত আট বছরে জেলার বিভিন্ন জায়গায় কিছু এমপি ও প্রভাবশালীদের হাত ধরে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি লোক আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন। বিশেষ করে নোয়াখালী-৬ নির্বাচনী এলাকায় বর্তমান এমপি আয়শা ফেরদৌসের স্বামী ও সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর হাত ধরে কয়েক হাজার বিএনপি-জামায়াত-শিবির ক্যাডার আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা এখন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হত্যার মিশনে নেমে পড়েছেন।

 কিছুদিন আগে বিএনপির টিকিটে যারা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে লড়েছেন, তারা এখন আওয়ামী লীগে এসে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায় আমরা আশাবাদী। এ ঘোষণার বাস্তবায়ন চাই। জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের বহু নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন। অতীত অপকর্ম থেকে রেহাই পাওয়া, দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, আগামী নির্বাচনে জনগণ থেকে দলকে বিচ্ছিন্ন করার টার্গেট নিয়ে তারা ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিয়েছেন। ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলায় কয়েক বছরে প্রায় ১০ হাজার নেতা-কর্মী বিভিন্ন দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে এসেছেন। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর জেলায় জামায়াত-বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে সবচেয়ে বেশি যোগদান করেছে। রংপুর বিভাগের সাত জেলায় মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের হাত ধরে বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির প্রায় ২৫ হাজার নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে বিগত উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে চেয়ারম্যান, মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। রাজশাহী অঞ্চলেও স্থানীয় এমপিদের নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত ও বাংলাভাইয়ের সহযোগীরা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। গত আট বছরে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের কমপক্ষে ১০ হাজার নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। ক্ষমতার পালাবদলে চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে নতুন করে ‘মুজিব সেনা’ হয়েছেন বিভিন্ন দলের কমপক্ষে ২৫ হাজার নেতা-কর্মী। তাদের মধ্যে নাশকতা, এমনকি হত্যা মামলার আসামিও রয়েছেন। এ বিভাগের তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে গত তিন বছরে কমপক্ষে ১০ হাজার নেতা-কর্মী দলবদল করেছেন। একইভাবে গত তিন বছরে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় প্রায় চার হাজার এবং সিলেট বিভাগের চার জেলায় এক হাজার নেতা-কর্মী বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। বরিশাল বিভাগে প্রায় তিন হাজার নেতা-কর্মী বিভিন্ন দল থেকে এসেছেন। ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলা, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগে আরও হাজারখানেক নেতা-কর্মী যোগ দিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর