মঙ্গলবার, ৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে নয়

আহমেদ আল আমীন

বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে নয়

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় বহাল রয়েছে। ওই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ঐকমত্যের ভিত্তিতে খারিজ হয়েছে। গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় দেয়। ফলে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকছে না। আদালত বলেছে, কিছু পর্যবেক্ষণসহ সর্বসম্মতভাবে আপিল খারিজ করা হলো। সকাল ১০টা ২৬ মিনিটে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি এজলাসে আসন গ্রহণ করেন। ১০টা ২৮ মিনিটে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। মামলাটি রায়ের জন্য আপিল বিভাগের কার্য তালিকার এক নম্বর ক্রমিকে ছিল। এর আগে শুনানি শেষে ১ জুন থেকে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এ রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করে বলেন, আদালত সর্বসম্মতিক্রমে আপিল খারিজ করেছে। যে আইনটি করে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া হয়েছিল, তা বেআইনি, অকার্যকর ও বাতিল হয়ে গেল। এর ফলে বিচারপতি অপসারণের বিষয়টি আগের মতো বিচার বিভাগই দেখবে। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘এ রায়ে আমি অত্যন্ত হতাশ। আমাদের যে আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ ৯৬-তে ফিরে যাব, তা আর হলো না। আমি অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করছি, হতাশ হয়েছি।’ রায় পুনর্বিবেচনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখনই তা বলা যাবে না। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করে, সরকারের সঙ্গে আলাপ করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার মতে সংবিধানের যে অনুচ্ছেদ সংসদ বাতিল করেছে, তা আপনাআপনি পুনর্বহাল হবে না। এ পরিস্থিতিতে শূন্যতা বিরাজ করছে। সংসদের কাজ তো আর আদালত করতে পারে না।’

২০১৪ সালে সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হলে তা রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দেয়। সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর আসাদুজ্জামান সিদ্দিকীসহ সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানির পর ষোড়শ সংশোধনী কেন অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না— তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাই কোর্ট। রুলের শুনানি শেষে গত বছরের ৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্ট। হাই কোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। আপিলের শুনানিতে ১০ জন অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য গ্রহণ করে আদালত। এর মধ্যে ষোড়শ সংশোধনীর বিরুদ্ধে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে মত দেন বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, রোকন উদ্দিন মাহমুদ, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, ফিদা এম কামাল, এ এফ হাসান আরিফ, এম আই ফারুকী, এ জে মোহাম্মদ আলী। তবে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি। আদালত মোট ১২ জন আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করলেও বাকি দুজন মতামত দেননি। ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের ওপর ন্যস্ত থাকলেও ’৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। ষোড়শ সংশোধনীর ৯৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ছাড়া কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাবে না। ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : দফা (২) এর অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি : ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, ‘উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণসংক্রান্ত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতাই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংবিধানপ্রণেতারা প্রথম থেকেই রেখেছেন। মাঝখানে মার্শাল ল অথরিটি বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখল করেছে। তারাই এ সংবিধানকে বিকৃত করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল প্রভিশন যুক্ত করেছে। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে আমরা বরং সংবিধানের মূল জায়গায় ফিরে গিয়েছি।’ রিটের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেছিলেন, ‘সদ্য স্বাধীন দেশে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় মূল সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে দেওয়া হয়েছিল। এরপর অভিজ্ঞতা অর্জনের পর ’৭৪ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নিজেই অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে ফিরিয়ে নেন। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকা উচিত নয়, সেটা বঙ্গবন্ধুরই সিদ্ধান্ত।’ মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী জনগণের মতামতে করা হয়নি। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দলের বিপক্ষে সংসদ সদস্যদের ভোট দেওয়ার অধিকার সংরক্ষিত না থাকায় বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা আইনসভার হাতে থাকলে তার রাজনৈতিক ব্যবহারের আশঙ্কা থাকবে।’

জনগণের বিজয় হয়েছে : সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে দেওয়া রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটি বলেছে, এর মধ্য দিয়ে জনগণের বিজয় হলো। গতকাল সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করার ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে নেওয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট তা আজ (গতকাল) অবৈধ ঘোষণা করেছে। সর্বোচ্চ আদালতের এ সিদ্ধান্ত জনগণের বিজয়।’ অন্যদিকে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘বিচারপতি অপসারণসংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ছিল সরকারের ষড়যন্ত্র ও দুরভিসন্ধিমূলক। সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্নের অপচেষ্টা করেছিল। আদালতের রায়ে তা নস্যাৎ হয়েছে। এ রায়ের মাধ্যমে আদালতের মর্যাদা ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রইল। সরকারের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ হলো। বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের ভরসার জায়গা অটুট থাকল।’ বিএনপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, এ বি এম মোশাররফ হোসেন, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, মাহবুবুল হক নান্নু, সেলিমুজ্জামান সেলিম, খোন্দকার মাশুকুর রহমান, মাওলানা আবদুল মালেক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। রিজভী আহমেদ বলেন, ‘সরকার বিচার বিভাগকে করায়ত্ত করার যে দুরভিসন্ধি করেছিল, সর্বোচ্চ আদালতের এ সিদ্ধান্তে সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হলো। আমরা সুপ্রিম কোর্টের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। বর্তমান জাতীয় সংসদের যে কমপোজিশন, তাতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ করার ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত থাকলে সেখানে চরম দলীয় কর্তৃত্বের প্রতিফলন ঘটত এবং নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার ক্ষুণ্ন হতো। বিচারকদের নানাভাবে প্রভাবিত করতে চাপ প্রয়োগের সুযোগ পেত।’ আপিলের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের ফলে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের আদালতের ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপের নিশ্চিত সম্ভাবনা দূরীভূত হলো। এ রায়ে জনগণের মনে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তার আশ্বাস আরও গভীরে পতিত হলো।’ এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘যখন এই ষোড়শ সংশোধনী করা হয়, যে সংসদে করা হয়েছে তা একটা একদলীয় সংসদ, এটা একটা দ্বিতীয় মেয়াদের বাকশালি সংসদ। এখানে অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে তারা এই সংশোধনী করেছিল। জাতীয় সংসদ উচ্চতর আদালতের বিচারকদের অপসারণ করবে, দলীয় কর্তৃত্বই এই জায়গায় প্রতিফলিত হতো। এতে ন্যায়বিচার ক্ষুণ্ন হতো এবং একজন ব্যক্তির কর্তৃত্বই এখানে আসত। সুতরাং আমরা মনে করি, সর্বোচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করেছে, তা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে এবং আগামীতে মানুষকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী করবে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে।’ ষোড়শ সংশোধনীর আগে বিচারক অপসারণের পদ্ধতি সম্পর্কে রিজভী বলেন, ‘যে পদ্ধতিটি আগে ছিল, ষোড়শ সংশোধনীর আগের যে অবস্থা— আমরা মনে করি সে অবস্থায় ন্যায়বিচার অনেকখানি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।’

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর