শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঠেকানোই যাচ্ছে না রেমিট্যান্সের পতন

আলী রিয়াজ

ঠেকানোই যাচ্ছে না রেমিট্যান্সের পতন

ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স দিন দিন কমছে। এর পতন কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। বরং প্রতি মাসেই এই রেমিট্যান্স কমার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এত দিন ধরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতেন সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকা প্রবাসী শ্রমিকরা। এবার ঈদুল ফিতরেও আগের মতো রেমিট্যান্স পাঠাননি। আগের বছরের তুলনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সৌদি আরব ও আমিরাত থেকে ১৩২ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার কম রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে। অথচ আগের বছরের তুলনায় আড়াই লাখ শ্রমিক বেশি  গেছেন এই দুই দেশে। অর্থনীতিবিদ ও জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্যান্য কিছু কারণ থাকলেও মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কারণে অবৈধ চ্যানেলে অর্থ আসছে বেশি। দ্রুত ও সহজলভ্য হওয়ায় বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে অবৈধ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দিকেই বেশি ঝুঁকছেন প্রবাসীরা। রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসীদের বিশেষ সুবিধা ঘোষণা করার পরও পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে না। নানা আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরও ঠেকানো যাচ্ছে না বিকাশ, রকেটসহ নানা নামের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অপব্যবহার।

জানা গেছে, ২০১৫ সালের পর মোবাইল ব্যাংকিং সম্প্রসারিত হওয়ায় সরাসরি ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে থাকে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বেগ প্রকাশ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ওপর কঠোর নজরদারি আরোপ করে। কয়েকটি ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনে সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও রেমিট্যান্সের স্বাভাবিক গতি পায়নি। বরং চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে প্রতি মাসে ব্যাপকভাবে কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া ও কুয়েত। এর মধ্যে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত থেকে প্রতি বছর ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া ও কুয়েত থেকে ১০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে। বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণে সৌদি আরবের অবস্থান সবার ওপরে। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে সৌদি আরব থেকে গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি। কিন্তু গত তিন বছর ধরে এই পরিমাণ কমছে। গত তিন অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ ছিল ২০১৪-১৫ সালে ৩৩৪ কোটি ডলার, ২০১৫-১৬ সালে ২৯৬ কোটি ডলার। সর্বশেষ অর্থবছরে তা আরও কমে হয়েছে মাত্র ২২৬ কোটি ডলার। এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ৭০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এভাবে দেখা যায় আরব আমিরাত থেকে ২০১৪-১৫ সালে রেমিট্যান্স এসেছে ২৮২ কোটি ডলার, ২০১৫-১৬ সালে ২৭১ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭ সালে ২০৯ কোটি ডলার। এক বছরে কমেছে ৬২ কোটি ডলার বা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০১৪-১৫ সালে এসেছে ২৩৮ কোটি ডলার, ২০১৫-১৬ সালে ২৪২ কোটি ডলার, ২০১৬-১৭ সালে ৭৪ কোটি ডলার কমে ১৬৮ কোটি ডলার এসেছে। মালয়েশিয়া থেকে ২০১৪-১৫ সালে এসেছে ১৩৮ কোটি ডলার, ২০১৫-১৬ সালে ১৩৩ কোটি ডলার, ২০১৬-১৭ সালে ২০ কোটি ডলার কমে এসেছে মাত্র ১১০ কোটি ডলার। কুয়েতে গত কয়েক বছরে প্রবাসী শ্রমিক রপ্তানির পরিমাণ কমেছে। তবে রেমিট্যান্সের পরিমাণও কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। দেশটি থেকে ২০১৪-১৫ সালে এসেছে ১০৭ কোটি ডলার, ২০১৫-১৬ সালে ১০৩ কোটি ডলার, ২০১৬-১৭ সালে ১০৩ কোটি ডলার। এর বাইরে ৮০ থেকে ১০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে এমন দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে যুক্তরাজ্য, ওমান ও কাতার। এর মধ্যে কাতার বাদে দুই দেশ থেকে গত এক বছরে রেমিট্যান্স কমেছে ৭ কোটি ডলার। এ ছাড়া বাহরাইন, লিবিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর রেমিট্যান্স কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স আহরণে ভারতে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ তালিকায় থাকলেও বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসার তালিকায় দেশটির নামই নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫৩১ কোটি ডলার বা এক লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ সালে ১৪৯৩ কোটি ডলার বা এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ অর্থবছরে তা আরও কমে এসেছে মাত্র ১২৭৬ কোটি ডলার বা এক লাখ কোটি টাকা।  বিষয়টি নিয়ে কথা বললে মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন, ব্যাংকে নানা ধরনের হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ডেস্ক খোলার নির্দেশ দিয়েছে। এটা পরিপালন হলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। সার্বিকভাবে রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে প্রবাসীদের অর্থের বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রবাসীদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার দর কিছুটা বেশি দেওয়া যেতে পারে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলেই এখন মানুষ রেমিট্যান্স পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানো অনেক বেশি নিরাপদ। সাম্প্রতিক সময় বেশকিছু কারণে রেমিট্যান্স কমেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছে। আমরা আশা করি আগামীতে পরিমাণ আরও বাড়বে।

সর্বশেষ খবর