শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

কোরবানিকে ঘিরে চলছে গরু মোটাতাজা প্রকল্প

ব্যবহার করা ওষুধ স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি মানব শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে বিভিন্ন রোগ

সাঈদুর রহমান রিমন

কোরবানিকে ঘিরে চলছে গরু মোটাতাজা প্রকল্প

ঈদুল আজহা সামনে রেখে ক্ষতিকর ওষুধ আর ইনজেকশন প্রয়োগ করে গরু মোটাতাজাকরণের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন অসাধু ব্যাপারিরা। রোজার ঈদের পর থেকেই কোরবানির বাজার ধরার টার্গেট নিয়ে বাছুর ও দুর্বল গরু কিনতে থাকেন তারা। এরপর ধাপে ধাপে গরুর দেহে প্রয়োগ করা হয় হরমোন ইনজেকশন, স্টেরয়েড, ডেক্সামেথাসন, ডেকাসনসহ বিভিন্ন ওষুধ। এসব ওষুধ আর ইনজেকশনে মোটা হওয়া গরুর মাংস খাওয়ার ফলে ওই ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় মানুষের শরীরে বাসা বাঁধে দুরারোগ্য ব্যাধি। এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মানুষের শরীরে জমে অতিরিক্ত চর্বি, ঘটে উচ্চ রক্তচাপ, দেখা দেয় কিডনি, লিভারের সমস্যা। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় মানুষ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ গরুগুলো সাধারণত ছোট ও দুর্বল প্রকৃতির হয়। ইউরিয়াসহ যেসব ওষুধ গরু মোটাতাজাকরণে ব্যবহার করা হয় তা  মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ওষুধ খাওয়ালে গরু মোটা হয় কিন্তু শরীরে মাংসের বদলে জমে থাকে চর্বি। এসব গরু থেকে সংগৃহীত মাংস খেলে মানুষের শরীরেও চর্বি জমে। এতে মানুষের কলেস্টেরল বাড়ে, উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। এ ছাড়া কিডনি, লিভারসহ পেটে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এ মাংস খেলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তবে যারা অতিরিক্ত পরিমাণে এসব গরুর মাংস খান তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। আর বেশি দিন রেফ্রিজারেটরে রেখে খেলে এসব রোগের আশঙ্কা আরও প্রকট হয়।’ প্রতি বছরের মতো এবারও কোরবানির পশুর হাট সামনে রেখে অবৈধ পন্থায় দেশজুড়ে চলছে গরু মোটাতাজাকরণের ভয়ঙ্কর বাণিজ্য। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ব্যাপারি পর্যায়ের অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা ঈদের দুই মাস আগে বাজার থেকে কম দামে বাছুর ও রোগা ধরনের গরু কিনে এসব ওষুধ খাওয়ানো শুরু করেন। এতে অল্প সময়ের মধ্যে গরু মোটা হতে শুরু করে। পরে কোরবানির হাটে ওই গরু বেশি দামে বিক্রি করা হয়। উপজেলা পর্যায়ের পশুখাদ্য বিক্রির দোকানগুলোয় এ ওষুধ বিক্রির রমরমা ব্যবসা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কয়েকজন গরু ব্যবসায়ী জানান, কম বয়সী বাছুরকে ডেক্সামেথাসন ও ডেক্সোভেট-জাতীয় বড়ি খাওয়ানো হয়। স্থানীয়ভাবে এ ওষুধকে ‘পাম্প’ বড়ি নামেও ডাকা হয়। এসব বড়ি খাওয়ানো হলে অল্প সময়ের মধ্যে গরু মোটা হয়ে যায়। গরুকে সুস্থ, ব্যথামুক্ত ও রোগমুক্ত রাখার দোহাই দিয়ে স্থানীয় হাটবাজার পর্যায়েও ডাইক্লোফেনাক, কেটোপ্রোফেন ইনজেকশন পুশ করা হচ্ছে। এসব ওষুধের কার্যকারিতা এক সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত প্রাণীদেহে বিদ্যমান থাকে। যদিও প্রাণীদেহের জন্য ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন। অন্যদিকে গরুকে ভিটামিন-জাতীয় খাবার খাওয়ানো শুরুর ১০-১৫ দিন পর হেমাটোপিন বিএস (১০এমএল) ইনজেকশন মাংসপেশিতে দিয়ে মোটাতাজা করা হয়। তা ছাড়া ডেক্সামেথাসন-জাতীয় ওষুধ পশু বা মানুষকে খাওয়ালে এর তীব্র প্রভাবে এক সপ্তাহের মধ্যে মোটাতাজা হয়। তবে এ মোটাতাজা বেশি দিন স্থায়ী হয় না, বড়জোর দুই থেকে তিন মাস। তবে গরু মোটাতাজাকরণের জন্য সব থেকে বেশি ব্যবহূত হয় স্টেরয়েড। কোরবানির পশুর হাটের গরুগুলো সাধারণত কেনার দু-তিন দিনের মধ্যেই জবাই করে ফেলা হয়। এ ক্ষেত্রে অবৈধ ব্যবসায়ীদের প্রয়োগ করা ওষুধ স্টেরয়েডের মাত্রা গরুর মাংসের মধ্যেই থেকে যায়। এ মাংস খাওয়ার ফলে ওষুধের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মানবদেহে প্রবেশ করে। এতে দেহের বিভিন্ন অংশে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে, কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ রোগাক্রান্ত হয়। এর জন্য দায়ী এসব বিপজ্জনক স্টেরয়েড। এ ছাড়া মেয়েদের অল্প বয়সে প্রজনন সক্ষমতা, শিশুদের অস্বাভাবিক মোটা হওয়া এবং অনেক ক্ষেত্রে নারীদের বন্ধ্যত্বের জন্যও দায়ী এসব ট্যাবলেট ও ইনজেকশন। অতিরিক্ত মুনাফার আশায় স্বল্প সময়ে গরু মোটাতাজা করতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন কোম্পানির ইনজেকশন ও পাউডার। ঈদের আগে কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজা করে মুনাফা বাড়িয়ে তোলার ধান্ধা চলে। ইনজেকশনের পাশাপাশি চরাঞ্চলের গৃহস্থদের কাছে ‘বালতি’ হিসেবে পরিচিত নোভারটিস কোম্পানির মেগাভিট ডিভির কদর বেশ। ভুসি ও খৈলের সঙ্গে মিশিয়ে পাউডার প্রতিদিন খাওয়ানো হয়। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে স্টেরয়েড, প্রি-ডেক্সানল, ডেক্সামেথাসন, বেটামেথাসন, পেরিঅ্যাকটিন, প্যারাডেক্সা ও ওরাডেক্সান নামে বিভিন্ন নিষিদ্ধ ওষুধ প্রয়োগ করে গরু মোটাতাজাকরণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন খামারিরা। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় এসব ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে গরুকে। এতে অল্প দিনে ফুলেফেঁপে উঠছে গরু। বাংলাদেশ ভেটেরিনারি সমিতির সদস্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমল সায়েন্সেস বিভাগের সভাপতি ড. খন্দকার মোজাফফর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কোরবানির ঈদে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেন। তারা গরু মোটা করার জন্য স্টেরয়েড-জাতীয় এক ধরনের ট্যাবেলট ও ইনজেকশন প্রয়োগ করেন। এতে গরু ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে অনেক মোটা হয়ে যায়। গরু অনেক সময় এই স্টেরয়েড সহ্য করতে পারে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ছাড়া গবাদিপশুকে পাম ট্যাবলেট সেবন ও স্টেরয়েড ইনজেকশন দেওয়ার পর স্বাভাবিকের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি মোটা দেখা গেলেও জবাইর পর কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ মাংস পাওয়া যায় না। কারণ এ ওষুধ দেওয়ার পর পশুর চামড়ার নিচের অংশে পানি জমাট বেঁধে স্তর তৈরি হওয়ায় দেখতে একটু মোটা দেখায়, এতে কোরবানির হাটে পশু কিনতে এসে ক্রেতা প্রতারণার শিকার হন। আর্থিকভাবে বিক্রেতা লাভবান হলেও হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।’ ড. খন্দকার মোজাফফর রহমান আরও বলেন, ‘তবে গরুকে ভিটামিন প্রয়োগ করে মোটাতাজা করলে এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে না। তিন-চার মাস সময় গরুকে ভালোভাবে ট্রিটমেন্ট করে মোটাতাজা করা যেতে পারে। এ সময়টাতে গরুকে কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে। ১৫ দিন পরপর গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর