মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ডুবন্ত নগরী চট্টগ্রাম

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

ডুবন্ত নগরী চট্টগ্রাম

টানা বর্ষণে গলা সমান পানি চট্টগ্রাম নগরীতে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

ক্রমেই ডুবে যাচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। ডুবন্ত চট্টগ্রামে জনদুর্ভোগ এবার রেকর্ড ছাড়িয়েছে। টানা বৃষ্টিতে সমুদ্র লাগোয়া পতেঙ্গা শুধু নয়, অফিসপাড়া আগ্রাবাদ ও বাণিজ্যকেন্দ্র চাক্তাই-খাতুনগঞ্জসহ নগরীর নিম্নাঞ্চল ডুবে পানিতে থই থই। কোমরপানিতে কোথাও গ্যাসের চুলা ও বৈদ্যুতিক হিটার ভেসে গেছে, কোথাও স্কুল-কলেজ, অফিসপাড়া ছবির মতো স্থবির হয়ে পড়েছে। জলবন্দী সড়কে কেউ নৌকায়, কেউ বয়ায়,  কেউবা ভেলায় ভেসে গন্তব্যে পৌঁছার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। চাক্তাই খাল লাগোয়া বস্তিগুলো শুধু নয়, সিডিএ এভিনিউ, আগ্রাবাদ, হালিশহর, আরাকান সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে জলবন্দী দশায় যান আটকে গিয়ে দুর্ভোগে পড়েন হাজার হাজার মানুষ।

এদিকে টানা বৃষ্টি ও কাপ্তাইয়ের বাঁধের অতিরিক্ত পানিপ্রবাহের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের বার্থিং ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে টানা বর্ষণের কারণে গতকাল সকাল থেকেই নগরীতে ছিল গণপরিবহন সংকট। ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, অটোরিকশাসহ যান চলাচলও ছিল কম। এ ছাড়া ভারি বর্ষণে পানিতে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামের সঙ্গে বান্দরবানের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

বারবার ডুবছে চট্টগ্রাম : অতিবর্ষণে নগরের প্রায় সব অঞ্চল ডুবে যায় ৩১ মে। টানা দুই দিন ছিল সেই জলাবদ্ধতা। এরপর গত মাসের ১২ জুন ফের প্লাবিত হয় নগর। ১৮ জুন আবার তলিয়ে যায় চট্টগ্রাম। ৩ জুলাই ভারি বর্ষণ হয় চট্টগ্রামে। এবারও ডুবে যায় বাণিজ্যিক নগরী। ২০ জুলাই কেবল নিম্নাঞ্চল জলাবদ্ধ হয়। কিন্তু রবিবার থেকে টানা ভারি বর্ষণে দেশের দ্বিতীয় এই বাণিজ্যিক নগরী কার্যত পানির নিচে। মাত্র ৫৪ দিনে চট্টগ্রাম ছয়বার জলাবদ্ধতার শিকার হয়। ফলে জলাবদ্ধতার নগরীতে রূপ নিয়েছে চট্টগ্রাম।

বন্দর পরিস্থিতি : বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও বৃষ্টি, ভরা জোয়ার ও কাপ্তাই বাঁধের বাড়তি পানিপ্রবাহের কারণে খাদ্যশস্যবাহী তিনটি জাহাজ জেটিতে খালাস না করেই অলস অবস্থায় বসে আছে দুই দিন ধরে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) দায়িত্বশীলরা এটি স্বীকার করে জানান, জাহাজের বার্থিং গতকালও চলেছে ঝুঁকিপূর্ণভাবে। চবক সদস্য জাফর আলম বলেন, টানা বৃষ্টি ও কাপ্তাই বাঁধের অতিরিক্ত পানিপ্রবাহের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের বার্থিং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তিনটি টাগবোটের মাধ্যমে গতকাল তিনটি জাহাজে স্বাভাবিক সফল বার্থিং করা হয়। এটি নিঃসন্দেহে পাইলটদের সাফল্যের বিষয়। তিনি এও জানান, জোয়ারের ছয় ঘণ্টা সময়ে বার্থিংয়ের সুযোগ থাকলেও অতিরিক্ত পানিপ্রবাহের কারণে তা চার ঘণ্টায় নেমে আসে।

জলদুর্ভোগে নগরবাসী : জলাবদ্ধতা যেন পিছু ছাড়ছে না চট্টগ্রাম নগরের বাসিন্দাদের। অতিবর্ষণে জলাবদ্ধতায় নাভিশ্বাস উঠেছে নগরবাসীর। দুই দিন ধরে টানা বর্ষণে নগরের প্রায় সব এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। অতীতে পানি ওঠেনি এমন এলাকাও প্লাবিত হয়েছে। ফলে নগরজীবনে চরম অস্বস্তি নেমে এসেছে। কার্যত মঙ্গলবার থেকেই শুরু হয় এই বৃষ্টি। শনিবার কিছুটা কম থাকলেও রবিবার থেকে ফের শুরু হয় ভারি ও টানা বর্ষণ। টানা বর্ষণের কারণে গতকাল সকাল থেকেই নগরীতে ছিল গণপরিবহন সংকট। ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, অটোরিকশাসহ যান চলাচলও ছিল কম। এদিকে ভারি বর্ষণে সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামের সঙ্গে বান্দরবানের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টির কারণে তলিয়ে যায় চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়ক।

কতটুকু বৃষ্টিপাত : পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১৯৬ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল বেলা ১টা ২৭ মিনিটে ভাটা শুরু হয় এবং রাত ৮টা ১৪ মিনিটে শুরু হয় জোয়ার। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা শেখ হারুনুর রশিদ বলেন, ‘মৌসুমি বায়ুর তারতম্যের আধিক্যের কারণে সাগরে বাতাসের তীব্রতা বেশি। তবে আজ থেকে বৃষ্টির তীব্রতা কিছুটা কমতে পারে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত অব্যাহত আছে। এ ছাড়া ভারি বর্ষণে পাহাড়ধসের আশঙ্কাও রয়েছে।’

নিম্নাঞ্চল পরিস্থিতি : চট্টগ্রামে টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানির কারণে গতকাল সকাল থেকেই বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে নগরের আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, আগ্রাবাদ সিডিএ, কমার্স কলেজ রোড, বারিক বিল্ডিং মোড়, চকবাজার, হালিশহর, ইপিজেড মোড়, ষোলশহর ২ নম্বর গেট, মুরাদপুর, বাকলিয়া, প্রবর্তক মোড়সহ বিভিন্ন এলাকা কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানিতে তলিয়ে যায়। সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সুদীপ বসাক বলেন, ‘জোয়ার ও প্রবল বর্ষণ একসঙ্গে হওয়ায় পানির পরিমাণ একটু বেশি ছিল। এই পরিমাণ পানি ধারণ করার মতো ক্ষমতা নগরের সমতল এলাকার নেই। ফলে অনেক নিম্নাঞ্চলে পানি জমে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।’ এদিকে বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় নগরের সড়কে গণপরিবহনের চরম স্বল্পতা দেখা দেয়। গণপরিবহন কম থাকায় অফিস, স্কুল-কলেজ, কর্মমুখী মানুষেরা যাতায়াতে চরম ভোগান্তির মুখে পড়েন। পরিবহন স্বল্পতায় যানবাহনে অতিরিক্ত ভাড়াও গুনতে হয়েছে যাত্রীদের। আবার অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও গন্তব্যে যেতে পারেননি অনেকে। অন্যদিকে দেশের অন্যতম বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ ও চাক্তাই এলাকায়ও ছোবল মেরেছে জলাবদ্ধতা। অতিবর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে বৃহত্তম এই বাজারগুলোর অনেক দোকান ও আড়ত। মূলত রবিবার থেকেই ব্যবসায়ীরা ক্রয়-বিক্রয় করতে পারছেন না। খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মুহাম্মদ জামাল হোসেন বলেন, ‘দেশের বৃহত্তম এই তিন বাজারের ব্যবসায়ীদের এখন নাজুক অবস্থা। প্রায় সব আড়ত ও দোকানে পানি প্রবেশ করেছে। ফলে নষ্ট হয়ে গেছে নানা পণ্য। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অনেক ব্যবসায়ী পণ্য রক্ষা করতে মালামাল অন্যত্র সরিয়েও নিয়েছেন।’

মেয়র যা বললেন : চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের সমস্যা। ফলে এর সমাধানও রাতারাতি হয়ে যাবে না। তবে চসিক ইতিমধ্যে শুধু জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। নানা প্রক্রিয়া শেষে এটি শিগগিরই একনেকে পৌঁছবে।’ তিনি বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসন চসিকের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য সব সেবাসংস্থাকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প নিতে হবে পরিকল্পিতভাবে। পরিকল্পিত প্রকল্পের মাধ্যমেই সম্ভব জলাবদ্ধতা নিরসন। যে সংস্থাই প্রকল্প গ্রহণ করুক, কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যদি চসিকের সঙ্গে সমন্বয় করা না হয়, তাহলে সমস্যা দেখা দেবে।’ সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগও নিশ্চিত করেছে, নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে চসিক ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ‘ফ্লাড কন্ট্রোল অ্যান্ড ওয়ারটার লগিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ শীর্ষক এ প্রকল্প ‘জিটুজি’ (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) পদ্ধতিতে অর্থায়ন করবে চীন। ইতিমধ্যে ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে। প্রকল্পটি ইআরডিতে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ কাজ শুরুর পর থেকে তিন বছর। এর আওতায় নগরীর ২৭টি খালের মুখে স্লুইস গেট নির্মাণ, ড্রেজিং, শহরের গুরুত্বপূর্ণ খালের মুখে পাম্পস্টেশন স্থাপন, কালুরঘাট থেকে শাহ আমানত সড়ক পর্যন্ত বাঁধ তৈরি এবং বাঁধের ওপর সড়ক নির্মাণসহ জলাবদ্ধতা নিরসনে নানা কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করা হবে।

বান্দরবান বিচ্ছিন্ন : অতিবর্ষণে চট্টগ্রামের সঙ্গে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গতকাল সকাল থেকেই সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। একই সঙ্গে পানি ওঠার কারণে সাতকানিয়ার সঙ্গে বাঁশখালীর সড়ক যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে। সাতকানিয়া-বান্দরবান সড়কের বাজালিয়া ও গরদুয়ারা এলাকায় বেশি পানি উঠেছে। সাতকানিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢল নামায় চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়ক তলিয়ে গেছে। ফলে ছোট আকারের গাড়িগুলো চলাচল করতে পারছে না। তবে আকারে বড় এমন গাড়িগুলো চলাচল করতে পারছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর