রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বর্ষণে ডুবল ঢাকা, ভোগান্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বর্ষণে ডুবল ঢাকা, ভোগান্তি

দুই দিনের বর্ষণে ডুবে যাওয়া মিরপুরে নৌকায় চড়ে যাতায়াত করতে হয়েছে স্থানীয়দের। দুর্ভোগ কমাতে নটর ডেম কলেজের সামনে ‘বিশেষ বোট’ নামায় ফায়ার সার্ভিস —বাংলাদেশ প্রতিদিন

টানা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে রাজধানী ঢাকার পথঘাট। প্রধান সড়কের কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর পানি। অলি-গলিও ছিল পানির নিচে। পানি ডিঙিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছেন অনেকেই। রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যাও ছিল কম। নৌকা চলতে দেখা গেছে মিরপুর ও কাজীপাড়ায়। সকালে অফিসগামী যাত্রীদের গণপরিবহনের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়। দিনভর সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছিলেন মানুষ। গতকাল বৃষ্টিতে পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে পল্টন, মতিঝিল, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর, মালিবাগ-মৌচাক ও রাজারবাগ এলাকা, মিরপুর-১০সহ বিভিন্ন অংশ, বাড্ডা, রামপুরা ও ধানমন্ডিসহ রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় ছিল জলাবদ্ধতা। সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, সড়কের ম্যানহোল এবং নিষ্কাশন নালার পিটগুলো খুলে দেওয়ার কাজ করেছে তারা। এ কাজে ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম’ মাঠে সক্রিয় ছিল। তারা জানায়, ময়লা জমে ড্রেনের অনেক জায়গায় ব্লক হয়েছে। সেগুলো ক্লিয়ারের কাজ করছে সিটি করপোরেশন। রাতেও তারা কাজ করবে। এদিকে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, প্রবল বর্ষণে রাজধানীর মতিঝিল, নটর ডেম কলেজের সামনের সড়ক, কারওয়ান বাজার, শেওড়াপাড়া তলিয়ে যাওয়া সড়কে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বোটে নগরবাসীকে চলাচলে সহায়তা করছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মালিবাগের দিকে মালিবাগ, রাজারবাগ, মৌচাক, শান্তিবাগ, গুলবাগ, মোমেনবাগসহ বিভিন্ন অলি-গলির সড়ক পানির নিচে। কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল রেস্তোরাঁর সামনে থেকে পল্টন মডেল থানার সড়কেও পানি উঠেছে বিভিন্ন ফুটপাথে। অবিরাম বৃষ্টির কারণে মালিবাগ-মৌচাকের দোকানপাটও খোলেনি দিনভর। গুলবাগ, শান্তিবাগ, মোমেনবাগসহ এই এলাকায় ভিতরের রাস্তাগুলো পানির নিচে। স্থানীয় মানুষজনকে পানি ডিঙিয়ে বাইরে বের হতে দেখা গেছে। বৃষ্টিতে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর, শুক্রাবাদ, ফার্মগেট ও ইন্দিরা রোড এলাকায়ও জলাবদ্ধতা দেখা যায়। এসব এলাকার কোথাও কোথাও কোমর পানিও দেখা গেছে। পশ্চিম নাখালপাড়া ও তেজকুনি পাড়ার বেশিরভাগ অলিগলিতে হাঁটু পানি জমেছিল। তেজকুনি পাড়ার অবস্থা বেশি শোচনীয়। পশ্চিম নাখালপাড়ায় একটু বৃষ্টি হলেই সড়কের পানি জমে থাকে। এ সড়কটি দীর্ঘদিন ধরে ভাঙাচোরা। সড়ক ব্যবহারকারী বাসিন্দাদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। মিরপুর ৬০ ফুট এলাকার এক বাসিন্দা জানান, ৬০ ফুট রাস্তার চতুর্দিকে পানি জমেছিল। বাজার করতে মিরপুরে-১ নম্বরে যাওয়ার কথা থাকলেও হাঁটুপানি দেখে ফিরে এসেছেন তিনি। রাজধানীর বাড্ডা, রামপুরা, খিলগাঁও, সবুজবাগ, বাসাবো, যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায় বলে জানান এলাকাবাসীর অনেকে। মধ্য বাড্ডার এক বাসিন্দা সকালে মতিঝিলে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে মোবাইল ফোনে বলেন, বাসার সামনে কোমর সমান পানি। তা ডিঙিয়ে মেইনরোডে এসে দেখি গুলিস্তান রুটের বাস নেই। অফিস ধরতে হবে, অন্য রুটের বাস ধরে যাচ্ছি। রামপুরা থেকে মাদারটেক, ত্রিমোহনী বা ডেমরাগামী যাত্রীরাও দুর্ভোগে পড়েন। ধোলাই পাড়া অলি-গলিতেও ছিল হাঁটু পানি। এ ছাড়া বিমানবন্দর সড়কের বিভিন্ন স্থানের দুই পাশেই পানি জমে ছিল। অন্যদিনের তুলনায় এদিন এ সড়কে কম যানবাহন থাকলেও বনানী কবরস্থানের সামনে পানির কারণে দুপুর ১২টার দিকে আর্মি স্টেডিয়াম থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত যানজট দেখা গেছে।

ছোট বড় প্রায় সব সড়কেই পানি : দুই দিনের টানা বর্ষণে মালিবাগ, খিলগাঁও, চৌধুরী পাড়ার প্রধান প্রধান সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। আবুল হোটেল থেকে খিলগাঁও তালতলাগামী রাস্তাটি এমনিতেই ভাঙাচোরা এবং নিচু। ফলে টানা বর্ষণে এই রাস্তার পুরোটাই হাঁটু পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে অনেক রিকশা এবং প্রাইভেট কার আটকা পড়ে। এমনকি এই রোডে দুটি বড় বড় স্কুল (সাউথ পয়েন্ট স্কুল, ফায়জুর রহমান আইডিয়াল ইনস্টিটিউট) রয়েছে। তবে শুক্রবার, শনিবার স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা হেমন্তের এই বৃষ্টির এই দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেয়েছে। এদিকে রামপুরা এলাকার মূল সড়কে উন্নয়নের কাজ চলায় সৃষ্ট খানাখন্দে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া এ এলাকায় বিভিন্ন মহল্লার ভিতরের ছোট বড় প্রায় সব সড়কই পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন এলাকাবাসী। এ ছাড়া খিলগাঁও, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, বাসাবো, গোড়ান, ভূঁইয়া পাড়া, নন্দীপাড়ার প্রায় সব রাস্তাঘাটই গতকাল সারাদিন পানির নিচে তলিয়ে ছিল। আবুল হোটেলের পশ্চিম পাশে চৌধুরী পাড়ার অনেক বাড়ির নিচতলায় এবং আঙিনা পানিতে তলিয়ে থাকতে দেখা গেছে। যা ওই এলাকার মানুষদের চরম দুর্ভোগে ফেলেছে। কোনো কোনো এলাকায় রাস্তার ধারে থাকা ডাস্টবিনের ময়লা পানিতে ভেসে মিশেছে। যা দিনভর রাস্তার পানিতে ভেসে থেকেছে। এতে ছড়িয়ে পড়ছে দূষণ। বনশ্রী থেকে কমলাপুরে আসা শফিক আহমেদ বলেন, কমলাপুর আসার পথে দেখলাম মালিবাগের চৌধুরীপাড়া এলাকায় কোমর সমান পানি। খিলগাঁও ডিসিসি মার্কেট থেকে আবুল হোটেল পর্যন্ত আসার পথটি পানিতে তলিয়ে গেছে। কোনো যানবাহন চলছে না। মালিবাগ রেলগেটেও একই অবস্থা।

কোমর পানিতে ভাসল মিরপুরবাসী : কোমর পানিতে ভাসল রাজধানীর মিরপুরের সাড়ে তিন লাখ বাসিন্দা। টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। অবিরাম বৃষ্টিতে মহানগরীর এ এলাকার অলি-গলিসহ কোনো কোনো এলাকার প্রধান সড়কেও পানি জমে গেছে। বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ চাকরিজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ। মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের দুটি স্থানে নৌকা চলতে দেখা গেছে। সকাল সাড়ে ১০টায় মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ফায়ার সার্ভিসের অফিসের সামনের সড়কে দেখা গেছে কোমর পানি। শতাধিক যাত্রী বিভিন্ন গন্তব্য যেতে গণপরিবহনের অপেক্ষায় রয়েছেন। এ এলাকার ফুটপাথের ওপর ছিল হাঁটুর ওপরে পানি। এ ছাড়া মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন থেকে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত সড়কটি পানিতে থৈথৈ করছে। অনেকে বাধ্য হয়ে নৌকা দিয়ে চলাচল করছেন। আবার কোথাও কোথাও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা জলাবদ্ধ সড়কে সাধারণ জনসাধারণকে পারাপারে সহযোগিতা করেছেন। এ ছাড়া রোকেয়া সরণি, মনিপুর, কল্যাণপুর, সেনপাড়া পর্বতা, কাফরুল ও দক্ষিণ বিশিল এলাকায় পানি জমে গেছে। সড়কে গণপরিবহনের উপস্থিতি কম হওয়ায় অনেক মানুষকে হেঁটে গন্তব্যে ফিরতে দেখা গেছে। কিছু কিছু স্থানে পানিতে আটকা পড়ে যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সরেজমিন ঘুরে আরও দেখা যায়, এ এলাকার অধিকাংশ সড়কই পানির নিচে। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানি। টানা বৃষ্টিতে এ পানি আরও বাড়ছে। বালি ভরাটের কারণে বৃষ্টির আগেই কালশী ও মিরপুর খালের পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। গত তিন দিন ধরে চলা টানা বৃষ্টিতে সে পানি আজ ভোগান্তির প্রধান কারণ। মিরপুরের মনিপুর এলাকায় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন মিলন মিয়া। জলাবদ্ধতার কারণে শুক্রবার সারাদিন গ্যারেজ থেকে রিকশা বের করতে পারেননি, গতকালও তাই। গ্যারেজের সামনেও কোমর পানি। মালিকের নির্দেশে ঘরে বসেই সময় কাটাচ্ছেন তিনি। কিন্তু তার মলিন মুখে ভেসে উঠেছে হতাশার ছাপ। বললেন, আমার মতো মানুষের জীবন আটকে গেছে বৃষ্টিতে। এ এলাকার বাসিন্দা হোসেন মিয়া বলেন, এসব এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষের ভোগান্তি চরমে। বৃষ্টির পানি অলিগলিতে ঢুকে পড়েছে। অনেক এলাকার ঘরে পানিতে সয়লাব। অনেক স্থানে ঢুকে পড়েছে বাসা-বাড়িতে।

আজ বৃষ্টি কমতে পারে : বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যার ফলে আজকের মধ্যে বৃষ্টিপাত কমতে পারে। সাগর উত্তাল থাকায় এখনো তিন নম্বর সতর্কতা সংকেত বলবৎ রয়েছে। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কাও দেখছে আবহাওয়া অধিদফতর। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, সাগরে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। তাই চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১-২ ফুট অধিক উচ্চতায় বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত ঢাকায় ১৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল ৬টা পর্যন্ত এই ২৪ ঘণ্টায় কেবল বৃষ্টি হয়েছে ১৪৯ মিলিমিটার।

সদরঘাট থেকে ৪১ রুটে নৌচলাচল বন্ধ : সারা দেশে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ঢাকার সদরঘাট থেকে সব ধরনের নৌচলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল সদরঘাট টার্মিনালে সকাল ৯টা থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ৪১টি রুটে নৌচলাচল বন্ধের এ নির্দেশ বহাল থাকবে। আবহাওয়া অধিদফতর থেকে দেশের সব নদীবন্দরে দুই নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত জারি রয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকা নদীবন্দর সদরঘাট এলাকায় একই ধরনের সতর্ক সংকেত জারি করা হয়। নৌ নিরাপত্তা বিভাগ এ কারণে দূরপাল্লার সব ধরনের নৌচলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. নাদিরুজ্জামান বলেন, নদীবন্দরগুলোতে দুই নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত অব্যাহত ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ঢাকা নদীবন্দর থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত এ নির্দেশ বহাল থাকবে। কর্তৃপক্ষের এ ঘোষণায় গতকাল সদরঘাটে যাওয়া দক্ষিণাঞ্চলে যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অনেকে সদরঘাটে গিয়ে ফিরে আসেন। সারা দিনের বৃষ্টিতে সদরঘাট থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হওয়ায় অনেক যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েন। লঞ্চের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরিশাল, আমতলী ও পটুয়াখালী রুটে লঞ্চের ট্রিপ চলার কথা ছিল। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সেগুলো বাতিল করা হয়।

সর্বশেষ খবর