সোমবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কী বার্তা নিয়ে এলেন সুষমা

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক, রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে, দিনভর ব্যস্ততা

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

কী বার্তা নিয়ে এলেন সুষমা

গণভবনে গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফিরে যাওয়াকেই একমাত্র সমাধান মনে করে ভারত। গতকাল ঢাকা সফরে এসে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এ মন্তব্য করেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে এ ব্যাপারে চাপ দেওয়ার জন্য ভারতকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের পুরোটা সময় ভারতের মানবিক সহায়তা অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছেন সুষমা। যদিও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো বক্তব্যে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি ব্যবহার করেছেন ‘রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত’ শব্দটি। বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ পরামর্শক সভা উপলক্ষে দুই দিনের সফরে গতকাল দুপুরে বিশেষ বিমানে ঢাকা পৌঁছান নয়াদিল্লির এই হেভিওয়েট মন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদির সরকারের বার্তা নিয়ে তিনি সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক তিনি তুলে দেন বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতে। পরে তিনি আধা ঘণ্টা কথা বলেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সুষমা বলেছেন, তিস্তা চুক্তিসহ  অমীমাংসিত সব ইস্যুতেই ভারত সরকার কাজ করছে। বৈঠকের পর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে দুটি সমঝোতা স্মারক ও একটি ইন্সট্রুমেন্ট হস্তান্তর হয়। ভারতের পক্ষ থেকে বিআইডব্লিউটিএকে দেওয়া হয় ১০ কোটি টাকার একটি চেক। সুষমা স্বরাজ আজ বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশে থাকা ভারতীয়দের অংশগ্রহণে কয়েকটি বৈঠক ও অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে দুপুরে ঢাকা ত্যাগ করবেন। গতকাল বেলা পৌনে ২টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু বিমানঘাঁটিতে বিশেষ বিমানে ঢাকায় নামেন সুষমা স্বরাজ। পরে বিকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বসেন বাংলাদেশ-ভারত চতুর্থ জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের বৈঠকে। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানান। বৈঠক শেষে মাহমুদ আলী বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার জন্য আমরা চেষ্টা করছি যেন রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফেরত যেতে পারে। সে জন্য আমি ভারতের প্রতি আহ্বান জানাই, তারা যেন মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এ সময় তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা দেওয়ায় ভারতকে ধন্যবাদ জানান।

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে যারা বাংলাদেশে এসেছে, তাদের ফেরত যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। রোহিঙ্গা ইস্যু প্রসঙ্গে শুরুতেই সুষমা বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা বাস্তুচ্যুত লাখো মানুষকে আশ্রয় দিতে বাংলাদেশকে সহযোগিতার জন্য গত সেপ্টেম্বরে আমরা শুরু করি অপারেশন ইনসানিয়াত। তিনি বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন চায় ভারত। ভারত মনে করে ওই এলাকায় দ্রুত উন্নয়নই রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে পারে। তাই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার ব্যাপারে ভারত গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, কিছু প্রকল্পে রাখাইন রাজ্যের স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা করবে ভারত। রাখাইন রাজ্যে দ্রুত আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ওই এলাকার বাসিন্দাদের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর এটাই হবে সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। এটি স্পষ্ট যে বাস্তুচ্যুত মানুষের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়েই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ে কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের দেওয়া প্রতিবেদন বাস্তবায়নের প্রতি ভারতের সমর্থনের কথা জানান সুষমা স্বরাজ। তিনি জানান, প্রায় তিন লাখ ‘বাস্তুচ্যুত’ মানুষকে চাল, ডাল, চিনি, লবণ, তেল, চা, দুধ, মশার কয়েল এবং সাবান দেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসনের কাছে এসব সহায়তা তুলে দেওয়া হয়েছে। এটা অব্যাহত থাকবে। বৈঠকে তিস্তা চুক্তি বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পানিসম্পদ আমাদের দুই দেশের বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করার উপাদান হিসেবে কাজ করবে। আমরা তিস্তাসহ দুই দেশের যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা ভারতকে মনে করিয়ে দিয়েছি যে, তাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, আমাদের দুই সরকারের সময়েই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হবে।’ এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের ভিতরে কিছু বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি।’

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক : সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তিনি ভারত সরকারের উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যৌথবাহিনীর ব্যবহার করা বেশ কিছু কর্মকৌশল, নথিপত্রসহ ঐতিহাসিক আলোকচিত্র, সে সময়ের কিছু অডিও ভিডিও ক্লিপিং, মানচিত্র, যুদ্ধের বিবরণী, সংবাদপত্রের অংশবিশেষ, প্রামাণ্যচিত্রসহ বেশ কিছু স্মারক। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন থেকে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অত্যন্ত আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুই দেশের চতুর্থ জেসিসি বৈঠকের বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ সময় তাদের আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে নিরাপত্তা, বাণিজ্য, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং উপ-আঞ্চলিক বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ভারত দ্রুততম সময়ে রাখাইনে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান চায় বলেও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন সুষমা স্বরাজ।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক : রাত ৮টায় সুষমা স্বরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হোটেল সোনারগাঁওয়ে যান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তাদের মধ্যে আধা ঘণ্টা কথা হয়। এরপর তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া নৈশভোজে অংশ নিয়ে দিনের ব্যস্ত কর্মসূচি শেষ করেন।

দুই সমঝোতা, এক ইন্সট্রুমেন্ট ও এক চেক হস্তান্তর : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চতুর্থ জেসিসি বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে আন্তর্জাতিক সোলার অ্যালায়েন্সের (আইএসএ) রেটিফিকেশন সংক্রান্ত ইন্সট্রুমেন্ট হস্তান্তর করেন। পরে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। একটি সই হয় ভারতের এইচএমটি ও বাংলাদেশের খুলনা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের মধ্যে। অপর সমঝোতা স্মারকটি ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মধ্যে গ্যাসোলিন বিক্রি সংক্রান্ত। পরে বাংলাদেশ-ভারত নৌ প্রটোকলের আওতায় বিআইডব্লিউটিএকে ১০ কোটি টাকার চেক হস্তান্তর করে ভারত।

সর্বশেষ খবর