বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

থামছেই না রোহিঙ্গা স্রোত

বিয়ে ঠেকাতে কড়া নির্দেশনা জারি মার্কিন কংগ্রেসে ফের আলোচনা

ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি, কক্সবাজার থেকে

নাফ নদ পাড়ি দিয়ে আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের স্রোত লেগেছে। গত দুই দিনে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে সহস্রাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সোমবার ভোর রাতে শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া, দক্ষিণপাড়া, খুরেরমুখসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে নৌকাযোগে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে এসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইনে পাহাড়ের খাদে এবং এপাড়া ওপাড়া থেকে এখন এপারে চলে আসছে। এক মাসের আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সেদেশের বিজিপি এদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। সেই থেকে প্রতিমুহূর্ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে নৌপথে আসা এসব রোহিঙ্গা খেয়ে না খেয়ে আছে বলে জানান। স্থানীয় পুলিশ ও বিজিবি সূত্র জানায়, গত দুই দিনে আসা এসব রোহিঙ্গাকে প্রথমে জালিয়াপাড়ার একটি মাদ্রাসায় বিজিবির হেফাজতে রেখে খাবার, চিকিৎসা ও অন্যান্য মানবিক সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে মঙ্গলবার থেকে তাদের বালুখালী ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। শাহপরীর দ্বীপ হয়ে আসা এদের অধিকাংশই মিয়ানমারের মংডুর দক্ষিণে নাইক্যনদিয়ায় এসে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান নেয়। সেখানে কেউ কেউ তাঁবু টাঙিয়ে অবস্থান করলেও খাদ্য সংকটে পড়ে ঝুঁকি নিয়ে নৌকাযোগে শাহপরীর দ্বীপে চলে আসে। চলতি মাসে পরপর দুবার নৌকাডুবির ঘটনায় ২৫ জনের অধিক রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর মৃত্যু হলে কিছুদিন বিজিবি কোনো নৌকা যেতে ও ভিড়তে দেয়নি শাহপরীর দ্বীপে। ফলে কয়েক দিন নৌপথে রোহিঙ্গা আসা বন্ধ হলেও গত তিন দিন ধরে আবারও আসা শুরু হয়েছে। এর আগে বিজিবি রোহিঙ্গা নিয়ে আসা ১২টি মিয়ানমারের নৌকার মাঝিকে আটক করে নৌকাগুলো ফুটো করে দেয়। তারপরও বন্ধ হয়নি রোহিঙ্গা আনা। এদিকে নিম্নচাপের কারণে সাগর উত্তাল থাকায় এর আগে তিন-চার দিন নাফ নদ হয়ে কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু গত সোমবার থেকে সাগরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় রোহিঙ্গারা আবারও নদী ও সাগরপথে এপারে আসা শুরু করেছে বলে জানান বিজিবি শাহপরীর দ্বীপ কোম্পানি কমান্ডার আবদুল জলিল। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইনুদ্দিন খান জানান, এখন আগের মতো দালালদের দৌরাত্ম্য নেই। রোহিঙ্গারা স্বপ্রণোদিত হয়ে এপারে চলে আসছে। আগে একটি দালাল চক্র টাকা ও রোহিঙ্গাদের স্বর্ণালঙ্কারের লোভে নৌকা করে তাদের এপারে নিয়ে আসার নামে হয়রানি করত। এখন প্রশাসন সতর্ক থাকায় সে ধরনের কিছু হচ্ছে না।

বিয়ে ঠেকাতে কড়া নির্দেশনা : নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মেয়েদের সঙ্গে বাংলাদেশি ছেলেদের বিয়ে বেড়ে যাওয়ায় কক্সবাজারসহ তিন পার্বত্য জেলায় বিয়ে নিবন্ধনে আরও সতর্ক হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। গতকাল আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বিয়ে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বর ও কনে দুজনেই বাংলাদেশের নাগরিক কিনা-জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে তা নিশ্চিত করতে হবে কাজী বা নিকাহ রেজিস্ট্রারদের। এ ক্ষেত্রে গাফিলতি হলে দায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের আদেশে আরও বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশি ছেলেদের সঙ্গে মিয়ানমার হতে আগত রোহিঙ্গা মেয়েদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয় হারে বৃদ্ধি পাওয়ায়’ জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে বর ও কনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার এই নির্দেশনা জারি করা হল।

মার্কিন কংগ্রেসে ফের আলোচনা : মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু মানুষের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও সহিংসতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর ফলে দেশের ভিতরে ও সীমান্ত অতিক্রম করে বাস্তুচ্যুত মানুষের ঢল নেমেছে। এতে প্রতিবেশী বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে এক মানবিক সংকট। মার্কিন কংগ্রেসের এক রিপোর্টে এ কথা বলা হয়েছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়, অর্ধশতাব্দী ধরে সামরিক শাসনের পর সম্প্রতি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে মিয়ানমারে শাসনব্যবস্থায় কিছুটা অর্জন হয়েছে। ভঙ্গুর এই ক্ষমতার পালাবদল বা অর্জনকে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতন খর্ব করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটি অন ফরেন রিলেশন্সের রিপোর্টে এসব কথা বলেছেন পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরবিষয়ক ব্যুরোর উপসহকারী মন্ত্রী ডব্লিউ প্যাট্রিক মারফি ও জনসংখ্যা, শরণার্থী, অভিবাসনবিষয়ক উপসহকারী মন্ত্রী মার্ক স্টোরেলা। ওয়াশিংটন ডিসিতে তারা মঙ্গলবার কমিটির কাছে দীর্ঘ এক প্রতিবেদন দাখিল করেন মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর।

‘জাতিগত নিধন’ বলতে আপত্তি একাংশের : রাখাইনের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনার আগ পর্যন্ত জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংসতাকে ‘জাতিগত নিধন’ আখ্যা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। নিউ দিল্লি টাইমসের এক প্রতিবেদন এ কথা বলা হয়েছে। সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি তাদের মঙ্গলবারের এক প্রতিবেদনে খবর দেয়, রাখাইনের সহিংসতাকে ‘জাতিগত নিধন’ আখ্যা দিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের জন্য একটি সুপারিশপত্র তৈরি করছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।

আন্তর্জাতিক আদালতের বিধান অনুযায়ী কেবল জাতিগত নিধনের কারণে আইনি পথ নেওয়ার সুযোগ নেই। সে কারণে রাখাইনের ঘটনায় ‘জাতিগত নিধনে’র অভিযোগ আনলে যুক্তরাষ্ট্রকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে না। জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় জাতিগত নিধনযজ্ঞকে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সমান্তরাল মনে করা হয় না। আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় এটি কোনো স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও জাতিগত নিধনকে গণহত্যা বিবেচনা করে না। এটিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই শুধুই জাতিগত নিধন মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবেও বিবেচিত হয় না। তবে নিউ দিল্লি টাইমস বলছে, আইনি কোনো পদক্ষেপের সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা নিপীড়নকে ‘জাতিগত নিধন’ আখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তাদের একাংশের সায় নেই। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক মার্কিন উপসহকারী মন্ত্রী প্যাট্রিক মারফি মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যের ভিতরে আমরা গুরুতর নৃশংসতার আলামত দেখেছি।’ রাখাইনের সহিংসতাকে ওয়াশিংটন ‘গণহত্যা’ নাকি ‘জাতিগত নিধন’ আখ্যা দেবে সেই প্রশ্নের প্রসঙ্গ টেনে প্যাট্রিক বলেন, ‘কীভাবে একে বর্ণনা করা যাবে সে ব্যাপারে আলোচনার টেবিলে সব সুযোগই রাখা আছে।’

এদিকে মার্কিন গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রমবিষয়ক সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী টম মালিনৌস্কি ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, ‘জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যা হলো একটি আইনি পরিভাষা। জাতিগত নিধন আইনি পরিভাষা নয়। নির্দিষ্ট ধরনের নৃশংসতা বর্ণনা করতে আমরা এ বুলিটি ব্যবহার করি। তা ছাড়া, এ ধরনের আখ্যাগুলো (জাতিগত নিধন) অতটা গুরুতর নয়। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কোন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু এ ধরনের আখ্যা (জাতিগত নিধন) কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা বহন করে না।’       

সর্বশেষ খবর