শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভ্রমণের বিড়ম্বনা

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

একটি বড় বাজপাখিতে চড়ে কক্সবাজার যাব বিয়ামে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারদের সঙ্গে কিছু লেখাপড়া অথবা চিকিত্সা-সংক্রান্ত সামাজিক বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করার জন্য। ঢাকা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে এসে ইউএস বাংলার কাউন্টারে যেতে বোর্ডিং পাস নিতে গেলে ভদ্রমহিলা সুন্দরভাবে বললেন, ফ্লাইট দুই ঘণ্টা বিলম্ব হবে। কিন্তু এর আগেই একই কাউন্টারে বসা এক তরুণ যুবককে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জানালেন, ইউএস বাংলার ফ্লাইট কখনো বিলম্বিত হয় না। একই সংস্থায় কাজ করে একই কাউন্টারে পাশাপাশি বসে দুই রকম জবাব! তবে সত্যি কি, ভদ্রমহিলার জবাব ছিল মার্জিত। আর ভদ্রলোকের জবাব নয়, দম্ভোক্তি ছিল অত্যন্ত রুক্ষ ও অহংকারে পূর্ণ। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ ধরনের আচরণে যে জিনিসটা প্রাধান্য পায়, তা হলো কোন পরিবেশ থেকে বড় হয়ে আসছে বা শিক্ষাদীক্ষা, বন্ধুবান্ধব, সবকিছুই এখানে বিবেচ্য এবং ব্যবহার বা ভাবের আদান-প্রদানে প্রতিটা জিনিসই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই ঘণ্টা বিলম্ব শুনে আমি হকচকিত হয়ে গেলাম। কেননা অতীতে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। আমি অনেক দিন যাবৎ শুক্রবারের বিমানে চড়ে কক্সবাজার বিয়ামে পৌঁছে দুপুরের খাবারের আগে একটি ক্লাস নিই। খাবারের পর বিকালে একটি এবং পরদিন শনিবার সকালে একটি ক্লাস নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। কক্সবাজার বিয়াম এবং বিসিএস ক্যাডার প্রশিক্ষণার্থীদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ তারা শুক্রবার দিনটি আমার জন্য উত্সর্গ করেন। এই ভেবে যে কক্সবাজার বিয়ামের পরিচালক উপসচিব মোজাম্মেল সাহেব ও তার কর্মকর্তারাও আমার প্রতি এত ভালোবাসা দেখান, সত্যি অকৃত্রিম। কিছুক্ষণ পর কাউন্টারের যে ভদ্রমহিলা দুই ঘণ্টা বিলম্বের কথা বললেন তিনি আবার জানালেন, ১৫ মিনিট বিলম্বে ছাড়বে। ইতিমধ্যে অন্যান্য প্রাইভেট এয়ারলাইনসের সামনে গিয়ে একটি টিকিট পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করে হতাশ হয়েছি। তাত্ক্ষণিক বিয়ামের পরিচালক মহোদয়কে জানালাম, মধ্যাহ্নভোজের পূর্বে ক্লাসটা বোধহয় নেওয়া যাবে না, ছেলেমেয়েদের তাদের মতো রিলাক্স করতে দিন। দুপুরের পরে শুরু হবে।

ইউএস বাংলার বেশ বড় বাজপাখিটির ৫/ডি আসনে বসলাম। কিছুক্ষণ পর আমার দুজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব আমার আসন অতিক্রম করার আগেই দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করলে, আমার বড়দি অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম, ডাকসুর সাবেক ভিপি অনেক আদর করেই বললেন, আমার ছোট ভাইটা কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? তারা আসছেন খেলাঘরের পক্ষ থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা অভিবাসীদের জন্য ত্রাণ বিতরণের জন্য। পাঠক, নিশ্চয়ই এটুকু পড়ে আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগছে, কেন এই প্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলতে গেলাম। প্রসঙ্গ একটি আছেই। ৪৫-৫০ মিনিটের এই আকাশযানে ভ্রমণে যে আনন্দ তা কোনোভাবেই উপলব্ধি করতে পারিনি। বরং এত বিরক্ত লাগছিল সামনের যাত্রীদের আচরণে, মনে হচ্ছিল নিশ্চয়ই আমার বয়স হয়েছে বা বুড়ো হয়ে গেছি। বিমানে চড়ে মানুষ নীলিমার নৈসর্গিক সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করেন, অথবা লেখাপড়া করেন। অথবা চিন্তা বা ধ্যানমগ্ন থাকেন। যে কোনো যন্ত্রদানবে দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে যে কোনো যাত্রীর সচেতনতা থাকে যে আমার জন্য যেন কারও কোনো অসুবিধা না হয়। সাধারণত বিদেশে ভ্রমণেও মানুষ একটি বই খুলে কয়েক পাতা পড়ে নেয় নিজের জ্ঞান সমৃদ্ধ করার জন্য। এমনকি কিছু খেতে গেলে ওপাশে বসা যাত্রীর অসুবিধা হয় কিনা এর দিকে লক্ষ থাকে বেশি। ৪ নম্বর সারির ABC II DEF আসনগুলোতে যেই ছয়জন ভদ্রমহিলা বসেছিলেন এবং আলাপচারিতা করছিলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছিল, তারা যেন রোহিঙ্গাদের মতো বিতাড়িত হয়ে গত কয়েক মাস কেউ কারও দেখা-সাক্ষাৎ পাননি, তাই এত কথা, অথবা পরকালের থেকে পুনর্জন্ম নিয়ে আবার একত্র হয়েছেন। আবার মনে হচ্ছিল, কোনো ধনীর দুলালী সকালে এত নাশতা করেছে, তাই শক্তিক্ষয় করার জন্য চিত্কার করে কথা বলছে। তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই পেছনের বা সামনের লোকটার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে কিনা। বিরক্তি বোধ করছে কিনা। বা তাদের কাজের ব্যাঘাত ঘটছে কিনা। এ ধরনের বিমান বা যে কোনো যন্ত্রদানবের যাত্রীদের প্রতি একটা অনুরোধ, হয় ধ্যানমগ্ন থাকুন বা নিদ্রিত থাকার চেষ্টা করুন, অথবা পড়াশোনায় নিমগ্ন থাকুন। তাহলে দেখবেন সুস্থ থাকবেন, জ্ঞান বাড়বে, নিজের উপকার হবে, অন্যেও স্বস্তিতে থাকবে। কিছু সময় স্রষ্টাতে ধ্যানমগ্ন থাকা এবং লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নেই। যে জাতির গুণগত মানসম্পন্ন লেখাপড়া নেই, সেই জাতির মতো অধম আর কোনো জাতি নেই। যে মানবসন্তান লেখাপড়ায় আগ্রহী নয়, সে পশু হতে বাধ্য হয়। ‘মানবসন্তান যখন জন্ম নেয়, তখন সে নিজে চিত্কার করে তার আগমনী বার্তা আত্মীয়স্বজনকে জানিয়ে দেয়, তার এ চিত্কার মাকে জীবিত এবং সুস্থ সন্তানের স্বস্তি দেয়। গর্ভাবস্থার ১০ মাসের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটায়। এই আগমনী বার্তা আনন্দের আবাহন বয়ে দিয়ে যায়। আমরা যখন মরে যাই তখন সবাই কথা বলে, শুধু মৃত ব্যক্তিই নির্বাক থাকে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু এবং প্রতিবেশীরাই কান্না করে জানান দিয়ে যায় মৃত ব্যক্তির চিরপ্রস্থানের খবর।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর