শনিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ছাত্রী অপহরণে রাবিতে তুলকালাম

ক্যাম্পাস থেকে তুলে নেওয়া হয় ফিল্মি স্টাইলে, ভিসির বাড়ি ঘেরাও, বিক্ষোভ

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী ও রাবি প্রতিনিধি

ছাত্রী অপহরণে রাবিতে তুলকালাম

সহপাঠীকে উদ্ধারের দাবিতে গতকাল রাবিতে বিক্ষোভ। ইনসেটে সন্দেহভাজন অপহরণকারী —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের সামনে থেকে এক ছাত্রী অপহরণের ঘটনায় তুলকালাম চলছে। গতকাল সকালে ওই ছাত্রী অপহূত হলেও রাত সাড়ে ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাকে উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। অপহরণের পরই সাধারণ ছাত্রীরা একত্রিত হয়ে ঘেরাও করেন উপাচার্যের বাসভবন। দুপুর থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন তারা। ছাত্রীদের বিক্ষোভ কয়েক দফা বন্ধের আহ্বান জানান উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান। কিন্তু অপহূত ছাত্রীকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত ছাত্রীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। সন্ধ্যায় অপহূত ছাত্রীর বাবা আমজাদ হোসেন মামলা করেন। এরপর পুলিশের উপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুত্ফর রহমান গতকালের (শুক্রবার) মধ্যে ছাত্রীকে উদ্ধারের আশ্বাস দিলে আজ (শনিবার) সকাল ১০টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও ওই ছাত্রীর সহপাঠীরা জানান, ওই ছাত্রী হল থেকে বের  হয়েছিলেন স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। হলের গেট থেকে ৫০ গজ এগোতেই তাকে জোর করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। তিনজন যুবক টেনে হিঁচড়ে জোর করে গাড়িটিতে তুলে নেয় তাকে। ছাত্রীটি এ সময় ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ওই শিক্ষার্থীকে এভাবেই ‘অপহরণ’ করা হয়। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপসী রাবেয়া হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে। ওই ছাত্রীর ‘স্বামী’ সোহেল রানা পেশায় একজন আইনজীবী। সোহেল রানা তাকে অপহরণ করেছেন বলে দাবি করেছেন ছাত্রীর বাবা।

ক্যাম্পাসের ভিতর থেকে শিক্ষার্থী অপহরণ ঘটনার প্রতিবাদে দুপুরের পর আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে রাবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক ছাত্রী হলের সামনে থেকে এক ছাত্রীকে ‘অপহরণ’-এর ঘটনায় খোঁজ দাবিতে আন্দোলনে নামেন বিভিন্ন হলের ছাত্রীরা। বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন তারা। অবস্থান কর্মসূচি থেকে অপহূত ছাত্রীকে উদ্ধারের দাবিতে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন। শিক্ষার্থীদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য থেকে একজন ছাত্রীকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই নিতে হবে। কারণ, এই সংরক্ষিত জায়গার মধ্য থেকে এক ছাত্রী অপহূত হওয়ার মানে এখানে আমরা কেউই নিরাপদ নই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদিও বলছে, এটি পারিবারিক ব্যাপার। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, ক্যাম্পাস থেকে তাকে কেন টেনে হিঁচড়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো? অপহূত ছাত্রীর সঙ্গে দুই ঘণ্টার মধ্যে আমাদের কথা বলিয়ে দিতে হবে। তিনি যদি বলেন, ভালো আছেন নিরাপদে আছেন, তবে আমরা আমাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করব। কিন্তু রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্তও অপহূত ছাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি সহপাঠীরা।আন্দোলনের একপর্যায়ে ওই ছাত্রীর বাবা ঘটনাস্থলে আসেন। পরে তিনি উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলার জন্য তার বাসভবনে প্রবেশ করেন। উপাচার্যের সঙ্গে প্রায় আধঘণ্টা কথা বলে বেরিয়ে এসে প্রশাসনের পদক্ষেপের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘আমি এখনো আমার মেয়ের কোনো সন্ধান পাইনি। এজন্য আমি খুবই উদ্বিগ্ন। এখনো জানি না আমার মেয়েকে কে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। তবে তার স্বামী আমার মেয়েকে “উঠিয়ে নিয়ে যাবে” বলে বিভিন্ন সময় হুমকি দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমার মেয়েকে উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। প্রশাসনের কাছে দাবি থাকবে, আমার মেয়েকে যেন দ্রুত ফিরিয়ে দেয়।’

এ সময় উপাচার্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘ওই ছাত্রীর স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়েছেন। তার স্বামী ও স্বামীর বাবা আইনজীবী। তারা আইনের বিষয়টি জানেন। ডিভোর্স কার্যকর হতে সময় লাগে। অনেক সময় দুই পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে, মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে। এমন কিছু হতে পারে। এটা কোনো অপহরণের মতো ঘটনা নয়। এ ঘটনায় তার পরিবার আইনের আশ্রয় নেবে।’ শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে গেলে আন্দোলন শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর নেতৃত্বে তারা সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল শেষে উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করেন। রাতের মধ্যেই ওই ছাত্রীকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন তারা। বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক খন্দকার ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘যেহেতু সামনের বছর তার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আছে, আর এটা পাবলিক পরীক্ষা, তাই একজনের জন্য ৯৯ জন শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বন্ধ করা হয়নি। আইনের কাছে আসলে মানবিক বিষয়টি নেই। আমরা সেশনজট কাটিয়ে উঠে বিভাগকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি, এখন পরীক্ষা পিছিয়ে দিলে আবারও বড় ধরনের সেশনজটে পড়তে হবে।’এ বিষয়ে মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান বলেন, শিক্ষার্থী অপহরণ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। আসামি গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। শিগগিরই তারা অপহূত ছাত্রীকে উদ্ধার করতে পারবেন।

এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবি, সব গেটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থাকেন। তার পরও এমন ঘটনা ঘটল। তবে নিরাপত্তাব্যবস্থায় কোনো ঘাটতি নেই বলে দাবি করেছেন ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তাব্যবস্থায় কোনো ঘাটতি নেই। গতকাল অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে আসেন। সেই সুযোগটি হয়তো কাজে লাগিয়েছে। তার পরও আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।’

সর্বশেষ : পুলিশ ছাত্রীর স্বামী অভিযুক্ত সোহেল রানার বাবাকে আটক করেছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, ছাত্রী উদ্ধার হওয়ার পর তারা বিশেষ ব্যবস্থায় তার পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করবে।

সর্বশেষ খবর