শনিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঢাকা চাইবে স্থায়ী সমাধান

আসছেন চীন জাপান জার্মানি সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ইইউ হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ মার্কিন সিনেটর কংগ্রেসম্যান ও কানাডার মন্ত্রী, চীন বাদে সবাই যাবেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

ঢাকা চাইবে স্থায়ী সমাধান

কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প —এএফপি

বিরল এক সফরে প্রায় একসঙ্গে ঢাকা আসছেন চীন, জাপান, সুইডেন ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ইইউর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ, কানাডার উন্নয়নমন্ত্রী ও মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের প্রতিনিধি দল। বিশ্ব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই সাত রাষ্ট্র ও জোটের হেভিওয়েট প্রতিনিধিরা আজ শনিবার দিন-রাতের বিভিন্ন সময় ও রবিবার ভোরে ঢাকা এসে পৌঁছবেন। ভিন্ন ভিন্ন বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকা আসবেন তারা। অতিথি হেভিওয়েটদের স্বাগত জানাতে সব প্রস্তুতি শেষ করেছে ঢাকা। বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গার ভারবহন করতে থাকা বাংলাদেশ  চায় সংকটের স্থায়ী ও টেকসই সমাধান। এই প্রত্যাশার কথাই অতিথিদের জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। এর আগে হেভিওয়েট অতিথিদের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরেজমিন দেখাতে নেওয়া হবে কক্সবাজারে। ঢাকা সফর শেষ করে ক্ষমতাধর সাত দেশের প্রতিনিধিরা মিয়ানমারে যাবেন এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিতে। সফরসূচি অনুসারে, হেভিওয়েটদের মধ্যে সর্বপ্রথম অতিথি হিসেবে আজ শনিবার দুপুরের আগে আগে বিশেষ বিমানে ঢাকা এসে পৌঁছবেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। সন্ধ্যায় ও রাতের প্রথম ভাগে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছবেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল ও সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগট ওয়ালস্ট্রর্ম। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারা কোনোকে নিয়ে বিশেষ বিমান ঢাকার আকাশসীমায় প্রবেশ করবে শনিবার মধ্যরাতে। রবিবার ভোরে পৌঁছবেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত জোটের পররাষ্ট্রবিষয়ক হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ ফেদেরিকা মোগেরিনি। তাদের বিমানবন্দরে স্বাগত জানাবেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। পরে রবিবার সকালে হেলিকপ্টারে করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কক্সবাজার যাবেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারা কোনো, জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল, সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগট ওয়ালস্ট্রর্ম ও ইইউহাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ ফেদেরিকা মোগেরিনি। একই সময়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ঢাকায় অবস্থান করলেও তিনি কক্সবাজার পরিদর্শনে যাবেন কিনা এ বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করেনি বেইজিং। ঢাকা এসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বলা হয়েছে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। অবশ্য আজ শনিবার দুপুরের আগে আগে ঢাকা পৌঁছানোর পর সরাসরি কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দিবেন দুই মার্কিন সিনেটর জেফ মার্কলে ও রিচার্ড ডারবিনের নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যের মার্কিন প্রতিনিধি দল। এই দলে থাকছেন আরও ৩ কংগ্রেসম্যান এবং চারজন স্টাফার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উখিয়ার ক্যাম্পে সময় কাটাবেন জাপান, সুইডেন, জার্মানি ও ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব, চিফ অব প্রটোকল এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকরা তাদের সঙ্গে থেকে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণ তৎপরতা ঘুরে ঘুরে দেখাবেন। সরাসরি আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কথাও শুনবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। রবিবার বিকালে ঢাকায় ফিরে তারা পৃথকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে  সাক্ষাৎ-বৈঠক করবেন। আজ শনিবার ও আগামীকাল রবিবার বিকালে চীন ও জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা আলাদা দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। পরে রবিবার সন্ধ্যায়ই নিজ নিজ বিশেষ বিমানে মিয়ানমারের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন জাপান, সুইডেন ও ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। তাদের বিদায় জানিয়ে রাত ৯টার দিকে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বিশেষ বিমানে মিয়ানমারের উদ্দেশে রওনা দিবেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। একইদিন সফর শেষে ঢাকা ছাড়বেন মার্কিন প্রতিনিধিরাও। এর আগে তারা কক্সবাজার থেকে ঢাকা ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সাক্ষাৎ, বৈঠক ও মতবিনিময় করবেন। হাইপ্রোফাইল এসব সফরের রেশ কাটার আগেই ২১ নভেম্বর ঢাকা আসবেন কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী মারি ক্লদ বিবুর। তিনি কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে সঙ্গে নিয়ে। পরে ঢাকায় ফিরে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক ও সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে শেষ করবেন দুই দিনের সফর। হেভিওয়েটদের সফরের বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগস্টে রাখাইনে অস্থিরতা শুরুর পর উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিত্বদের এমন সমন্বিত সফর এটিই প্রথম। ইউরোপের দেশগুলো, জাপান এবং ইইউর উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধির সমন্বিত এ সফর রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশগুলো এবং সংস্থার সমর্থনের প্রতিফলন বলে মনে করে বাংলাদেশ। তারা উখিয়ার কুতুপালংয়ে মানবিক সংকট পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখবেন। জাতিসংঘের অধীন সংস্থাগুলো এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময় করবেন। বাংলাদেশ আশা করছে— রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আগামী দিনেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে এ সফরগুলো ভূমিকা রাখবে। ঢাকায় সুইডেনের দূতাবাসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগস্টের পর ছয় লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের পর কক্সবাজারে শরণার্থী ক্যাম্পে  যে মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা দেখতেই আসছেন সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগট ওয়ালস্ট্রর্ম। ব্যাপক দমন-পীড়ন ও যৌন সহিংসতা চালানো হলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় বলে উল্লেখ করেছে সুইডেন দূতাবাস।

চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর ঘিরে ভিন্ন মাত্রা : আন্তর্জাতিক সমর্থনের পাল্লা বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকে পড়লেও মিয়ানমারের পক্ষে সবচেয়ে বড় সমর্থন জোগানো চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর ঢাকা সফর ভিন্ন মাত্রার সৃষ্টি করেছে। অন্য সব পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগে তিনি ঢাকা এসে পৌঁছলেও অন্যদের সঙ্গে তিনি কক্সবাজার সফরে যাচ্ছেন না। এ কারণে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে অন্যদের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের কথা বলা হলেও নেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা। সূত্রের খবর, বেইজিং থেকে ঢাকাকে জানানো হয়েছে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সর্বশেষ ঢাকা সফরে যেসব চুক্তি হয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়নের দিকটি খতিয়ে দেখাই চাইনিজ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের উদ্দেশ্য। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ বিষয়গুলোর পর্যালোচনা হবে। তবে ঢাকার পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা উত্থাপন হবে। সেই সঙ্গে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে কক্সবাজার সফরের জন্যও আমন্ত্রণ জানাবেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অন্যদিকে, ওয়াং ইর সফর উপলক্ষে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং সুয়াং বেইজিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সপ্তাহে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করবেন এবং দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় ও আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করবেন। ঢাকার সফরের পর তিনি সোম ও মঙ্গলবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে এশিয়া ও ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দেবেন। তবে ওয়াং ইর আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি আসবে কি না- সে বিষয়ে কিছু বলেননি চীনা পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র।

টেকসই সমাধানের প্রত্যাশা : কূটনৈতিক সূত্রের খবর, রোহিঙ্গাদের বিশাল ভার বহন করতে থাকা বাংলাদেশ সাময়িক কোনো সমাধানের পরিবর্তে স্থায়ী ও টেকসই সমাধান প্রত্যাশা করছে। কারণ গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থাকছে। তাই এবার বিশাল ভার বহন করতে হলেও একেবারেই সংকটের সমাধান হয়ে যাওয়ার প্রত্যাশার কথাই অতিথি মন্ত্রীদের জানাবেন ঢাকার কূটনীতিকরা। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবিত পাঁচ দফার ভিত্তিতে তৈরি করা কর্মকৌশলে সমাধান সম্ভব বলে জানানো হবে বিদেশি পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতার কারণে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার অপরিহার্যতার কথাও আরেক দফায় তুলে ধরা হবে বিদেশি হেভিওয়েট অতিথিদের এসব সফরে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর