সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নকলবাজিতেই সব বন্দী

সিসি ক্যামেরা মোবাইল সেট টিভি প্রসাধনী মিষ্টান্নসহ বিভিন্ন পণ্য নকলে আসল চেনা দায়, আছে নকল পুলিশ ডিবি র‌্যাব ডাক্তার কর কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেট, রাজনৈতিক দলেও আছে আসল-নকল, মিলছে নকল আসামিও

সাঈদুর রহমান রিমন

নকলবাজিতেই সব বন্দী

দেশে নাগরিক জীবনযাত্রার সবকিছুই নকলবাজিতে বন্দী হয়ে পড়েছে। একদা কেবল পরীক্ষার ক্ষেত্রে টুকিটাকি নকলের কথাই জানা ছিল মানুষের। এখন নকল জন্মদান থেকে শুরু করে ‘ভুয়া মৃত্যু’ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই নকলের একচ্ছত্র দাপট। নকলবাজির এ সাম্রাজ্যে সবই আছে, শুধু ‘আসলটাই’ উধাও। বাজারে এমন কিছু নেই, যা নকল হয় না। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে সার, কসমেটিকস, পানীয়, ইলেকট্রনিক, অটোমোবাইল পার্টস, পাইপ, প্লাস্টিক পণ্য, সিমেন্ট, ভুয়া ডাক্তার, ভুয়া পুলিশ, ন্যাশনাল আইডি—কী নেই নকল? নকল-ভেজাল-মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যসামগ্রীতে ছেয়ে গেছে দেশ। অবলীলায় এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে চোখের সামনেই। পণ্য ভেরিফিকেশনের জন্য হলোগ্রাম, স্টিকার, স্ক্যানার, আরএফআইডি ট্যাগ, বারকোড ইত্যাদি সিস্টেম চালু আছে। কিন্তু সেসব হলোগ্রাম বা স্টিকারগুলোও যখন নকল করা হয় তখন গ্রাহক কোনোভাবেই আর আসল-নকল আলাদা করতে পারেন না। চকচকে মোড়কে মোড়ানো পণ্য মানেই যে ‘আসল’ তা কিন্তু নয়। বরং আসলের চেয়ে ‘নকল’ পণ্যের প্যাকেট অধিক উন্নত, বেশি চকচকে। পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগ ও কেরানীগঞ্জের অলিগলিতে প্রস্তুতকৃত নকল ও নিম্নমানের সাবান, চন্দন, মেছতা-দাগনাশক বিভিন্ন ক্রিম, নানা প্রসাধনী, তেল, পারফিউম সবকিছুই পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হচ্ছে। এসব নকল সামগ্রীর প্যাকেট বা বোতলে সাঁটানো থাকে বিভিন্ন দেশের লেভেল। রকমারি বিদেশি পণ্যের সমারোহে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। পৃথিবীর যত নামকরা ব্র্যান্ডের প্রসাধনসামগ্রী এর সবই তৈরি হচ্ছে ঢাকা ও আশপাশ এলাকার কারখানায়। ‘নকল হইতে সাবধান’—এই বিজ্ঞাপন দেখেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। নকল ফোন, নকল স্বাক্ষর, নকল দলিল, নকল চাল, নকল ডিম পর্যন্ত মার্কেটে বেরিয়েছে। এখন নকলের নতুন এডিশন ‘নকল পাত্র-পাত্রী’। আপনি হয়তো ভাবছেন পাত্র-পাত্রী আবার নকল হয় কী করে! সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সদস্যরা ম্যাস মিডিয়া ও বিভিন্ন ঘটক ভাইয়ের নামে প্রতিষ্ঠান খুলে এই নকল পাত্র-পাত্রীর রমরমা বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে। ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা গেলেও নকল মানুষ চেনার উপায় না থাকায় ‘নকল পাত্র-পাত্রীর’ প্রতারণা থেকেও রেহাই মিলছে না।

অভাব শুধু আসলের : সর্বত্রই নকল আর ভেজালের ছড়াছড়ি। দিন দিনই এর মাত্রা আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে। ভেজাল খাদ্যপণ্যে সয়লাব হয়ে পড়ছে শহর-বন্দর-জনপদ। খোলাবাজার, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড থেকে শুরু করে চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, কনফেকশনারি, ক্যান্টিন, এমনকি মুদিদোকান পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটেছে নকলের। নগরীর কোনো খাদ্যজাত দ্রব্যটি ভেজালমুক্ত তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। চাল, ডাল, তেল, সাবান, আটা থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল। এ ছাড়া ব্যবহার্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও নকল হচ্ছে। টাকা দিয়ে কিনতে গিয়ে আসল-নকলের বিভ্রান্তিতে ভুগছে মানুষ। পুরান ঢাকার শত শত ভেজাল কারখানায় তৈরি হচ্ছে লাইট, ফ্যান, মশার কয়েল, ঘি, পানের জর্দা, সেমাই, নুডলসসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী। আর ভেজাল মিনারেল ওয়াটার কারখানা তো নগরী জুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভেজালবিরোধী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন কেমিক্যাল আর পিয়াজের রস মিশিয়ে তৈরি করা হয় এক নম্বর খাঁটি সরিষার তেল। ছানার পরিত্যক্ত পানির সঙ্গে আটা, ময়দা, ভাতের মাড়, এরারুট মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘খাঁটি দুধ’। মরিচের গুঁড়ায় ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক রং ও ইটের গুঁড়া। কাউন ও কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে তৈরি করা হয় প্যাকেট মসলা। প্রসাধনীতে ব্যবহূত হচ্ছে হরেক নকলের ক্ষতিকর উপাদান। নোংরা পানি ব্যবহারের মাধ্যমে আইসক্রিম বানানো হচ্ছে। শিশুখাদ্য দুধও ভেজালমুক্ত রাখা যাচ্ছে না। অতিরিক্ত রেডিয়েশনযুক্ত গুঁড়াদুধ আমদানি হচ্ছে দেদার। মিষ্টি, রসমালাই তৈরির প্রধান উপাদান দুধে ফরমালিন, চিনিতে চকপাউডার ও ইউরিয়া মেশানোসহ শালটু হাইড্রোয়েট, বেকিং পাউডার ও ৫৫৫ নামের মেডিসিন ব্যবহার করা হচ্ছে অহরহ। ইউরিয়া, ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল মিশিয়ে মাছকে বিপজ্জনক বিষে পরিণত করা হচ্ছে। মাছ তাজা থাকা অবস্থায় ইনজেকশনের মাধ্যমে ফরমালিন পুশ, ফরমালিন মেশানো পানি দিয়ে তৈরি বরফের পাটা দিয়ে দিনভর মাছ চাপা রাখা হচ্ছে। ভেজাল খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করে ডিএসসিসির ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করেও ফরমালিন পাওয়া যায়নি। মূলত ল্যাবরেটরির মেশিনারিজেরই সক্ষমতা নেই।

জানা গেছে, জীবন রক্ষাকারী স্যালাইনেও ভেজাল মিশিয়ে বিষে পরিণত করা হয়েছে। ফুটপাথেই বিষময় ওষুধের পসরা সাজিয়ে বসছেন হাতুড়ে ডাক্তাররা। ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে হাঁস-মুরগির খাবার। দেশে জীবনযাত্রার প্রায় সব ক্ষেত্রেই রয়েছে নকলের সীমাহীন দৌরাত্ম্য। লিপস্টিক, লোশন নকল করে তৈরি করা হচ্ছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছেয়ে গেছে নকল ও ভেজাল প্রসাধনসামগ্রী। এসব কারখানায় বাজারে প্রচলিত দেশি-বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর বোতল ও কৌটা, লেভেল ও ট্রেডমার্ক হুবহু নকল তৈরি করছে। অসাধু চক্রটি বিএসটিআই অনুমোদিত একটি পণ্য লাইসেন্সের আড়ালে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল পণ্য তৈরি করছে। এসব পণ্য নগরীর অভিজাত মার্কেট থেকে গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারেও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ব্যবহারকারীদের মধ্যে। অনেক দাম দিয়ে নামি ব্র্যান্ডের মোড়কে ভেজাল কসমেটিকস কিনে অজান্তেই চরম স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত অতি লাভের আশায় অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল পণ্য উৎপাদন করছেন। ১০০ গ্রাম ওজনের একটি জনসন বেবি সোপের দাম পড়ে ৭০ টাকা। সেখানে ভেজালকারীদের উৎপাদন খরচ হয় মাত্র ৫-৬ টাকা। তারা এগুলো পাইকারি বিক্রি করে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। আর খুচরা দোকানিরা বিক্রি করে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। আসল আর নকল পণ্যের মানে যতই পার্থক্য থাকুক, দামে তেমন ফারাক থাকে না। শুধু লাভ আর লাভ। একটি ফগ ২৫০ এমএল কনটেইনার বডি স্প্রের দাম পড়ে ২৫০ টাকা। আমদানি মূল্য ১৯০ টাকা। দোকানে দেওয়া হয় ২২০ থেকে ২২৫ টাকায়। একই পণ্য তৈরিতে নকলকারীদের খরচ হয় ৪০ টাকার মতো। পাইকারি বিক্রি করে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। আর খুচরা দোকানি বিক্রি করেন ২০০ টাকা। ৫০০ এমএল সানসিল্ক শ্যাম্পু বাজারে দাম ৪৫০ টাকা। আমদানি খরচ পড়ে ৩৫০ টাকা, পাইকারি বিক্রি ৩৮০ টাকা। কিন্তু নকল ৫০০ এমএল শ্যাম্পু উৎপাদনে ব্যয় হয় মাত্র ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এভাবেই প্রতিটি পণ্যে তিন-চার গুণ লাভের আশায় নকল পণ্য বিক্রিতে উৎসাহ বোধ করেন।

আসল জিনিস চলেই না... : দেশের বাজারে আসল উইন্ডোজ সিডির দাম কেমন? আইডিবির বিভিন্ন দোকানে গিয়ে জানা যায়, উইন্ডোজ ৭-এর দাম ১২ হাজার ৫০০, উইন্ডোজ ১০-এর দাম ১৪ হাজার ৫০০ টাকা। কোনো দোকানে উইন্ডোজ ১০-এর প্রফেশনাল ভারসনটি পাওয়া যায় ১৩ হাজার ৫০০ টাকায়। কিন্তু পাইরেটেড উইন্ডোজ সিডি ৫০-৬০ টাকায় কিনে নিচ্ছেন সবাই। আসল উইন্ডোজের সিডি একেক দোকানে বছরে ২-৫টি বিক্রি হলেও উইন্ডোজের ক্র্যাক ভারসন বা ট্রায়াল ভারসনের সিডি প্রতিদিন দুই শতাধিক বিক্রি হচ্ছে। এক কম্পিউটার ব্যবসায়ী জানান, ‘দেশে আসল উইন্ডোজের ব্যবহার এখনো গড়ে ওঠেনি। আর এর মূল কারণ আসল উইন্ডোজের দাম প্রচুর।’

নকল ডিবি, ভুয়া র‌্যাব : নকল ডিবি, ভুয়া র‌্যাবের দৌরাত্ম্যে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এ চক্রের কবলে পড়ে সীমাহীন হয়রানি ও টাকা-পয়সা খোয়াতে হচ্ছে। নকল পুলিশ, নকল ডিবি সেজে একটি চক্র রাজধানীসহ সারা দেশে মারাত্মক সব অপরাধ ঘটাচ্ছে। তারা গ্রেফতারের নামে অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি চালাচ্ছে বাধাহীনভাবে। শুধু যে ভুয়ারাই অপকর্মটি করছে তা নয়, আনসার সদস্যরা নকল পুলিশ, পুলিশ সদস্যরা ডিবি কিংবা র‌্যাব সেজে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। অতিসম্প্রতি আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় ডিবির ওসি পরিচয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে শিল্পপুলিশের এক এএসআইসহ চারজনকে আটক করা হয়। এর আগে পল্টন, ধানমন্ডি, যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে নকল ডিবি, ভুয়া র‌্যাব চক্রের প্রায় দুই ডজন সদস্যকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এ চক্রের সদস্যরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দ্রুত জামিনে বেরিয়ে এসে আরও দ্বিগুণ উৎসাহে একই অপরাধকর্মে লিপ্ত থাকছে।

বিএনপি বনাম ‘আসল বিএনপির সংঘর্ষ : ভুয়াবাজির দেশে কোথায় নেই নকল? রাজনৈতিক দলের মধ্যেও আসল-নকলের লড়াই দেখতে পেয়েছেন রাজধানীবাসী। নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখল নিয়ে বিএনপি ও ‘আসল বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সময় আসল বিএনপির কর্মী বহন করা একটি পিকআপ ভ্যান আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। এতে উভয় পক্ষের বেশ কজন আহত হন।

কুমিল্লার আসল রসমালাই কোথায় পাবেন? : রসমালাই মানেই কুমিল্লার পুরাতন মাতৃভাণ্ডার। প্রতিষ্ঠানটির খ্যাতি দেশজুড়ে। কুমিল্লার মনোহরপুর কালিবাড়ী এলাকায় অবস্থিত মাতৃভাণ্ডারে প্রতিদিন অসংখ্য ক্রেতার ভিড় থাকে এখনো। কোথাও কোনো শাখা নেই এর। কিন্তু সেই খ্যাতি কাজে লাগিয়ে প্রতারণা করছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। মাতৃভাণ্ডারের নামের আগে-পিছে বিশেষণ লাগিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কুমিল্লা সদর, সদর দক্ষিণ, বুড়িচং, চান্দিনা এলাকায় গড়ে উঠেছে শতাধিক মাতৃভাণ্ডার। অভিযোগ রয়েছে, এসব মাতৃভাণ্ডার থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ রসমালাই কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। ম্যাঙ্গো ড্রিঙ্কসহ বিভিন্ন ফলের জুস ও এনার্জি ড্রিঙ্কে ফলের রসের অস্তিত্ব মেলে না। অন্তত ১০ শতাংশ ফলের রস থাকা বাধ্যতামূলক হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফ্লেভার ছাড়া কিছু থাকে না। এ কারণে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ড্রিঙ্ক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু বহাল তবিয়তেই চলছে তাদের নকলবাজির কর্মকাণ্ড। চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন মার্কেটে গজিয়ে ওঠা নকল বাটা শোরুম থেকে জুতা কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। নগরীর চৈতন্যগলিতে তৈরি এসব বাটা জুতা দেখতে একই রকম হলেও গুণগত মানে অনেক ফারাক। প্রতারিত ক্রেতারা জুতা নিয়ে আপত্তি জানাতে এসে নকল বাটা শোরুমের মালিক ও বিক্রয়কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন।

নকল টিভিও আসল হয় স্টিকারের গুণে : দামি ব্র্যান্ডের মনোগ্রামযুক্ত স্টিকার বসিয়েই নকল টিভি আসল টিভিতে পরিণত হয়ে যায়। স্যামসাং, এলজি, সনি সবই মেলে। নির্ধারিত দোকানের চেয়ে টিভিগুলোর দাম অর্ধেকেরও কম রাখা হয়। ক্রেতারা অল্প দামে নামি ব্র্যান্ডের টিভি কিনে নেন খুশিমনে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ঘটে বিপত্তি। মেলে না বিক্রয়োত্তর সেবাও। অগত্যা ফেলে দিতে হয় এ ধরনের টিভি সেট। ডাইসের মাধ্যমে দামি ব্র্যান্ডের লোগো বসিয়ে দেওয়া হয় টিভি সেটের ওপর। ক্রেতাদের ধোঁকা দিতে কম্পিউটারে সফটওয়্যার বসিয়ে দেওয়া হয়। ফলে টিভি সেট চালু করলে অবিকল স্যামসাং, এলজি কিংবা সনি লেখা ভেসে ওঠে টিভির পর্দায়। সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট ও কাপ্তানবাজারের ছয়টি দোকানে র‌্যাবের অভিযানে এ ধরনের সফটওয়্যারসহ এক হাজার স্টিকার উদ্ধার হয়।

আসল-নকলের মারপ্যাঁচে বৃদ্ধ কারাগারে : চকচকে দেখে খরচ না করে চার মাস ধরে এক হাজার টাকার নোট দুটি ঘরে রেখে দিয়েছিলেন দিনমজুর পর্বত শেখ (৫০)। কিন্তু বর্ষা এসে গেছে আর ঘরের চালও ছিদ্র। তাই বাধ্য হয়ে নোটগুলো নিয়ে টিন কিনতে যান দোকানে। তখনই জাল টাকা রাখার দায়ে গ্রেফতার হন তিনি। আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বগুড়ার শেরপুর বাসস্ট্যান্ডের নন্দীগ্রাম সড়কে টিন বিক্রির একটি দোকান থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।

ফেসবুকে প্রতারণা, আসল-নকল পত্রিকা : ১৪ অক্টোবর ফেসবুকে নকলবাজির ভয়ঙ্কর প্রতারণার শিকার হয়েছে দেশের প্রথম সারির বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিক। মাস্টহেড অবিকল রেখে প্রধান বিচারপতির বিদেশ যাওয়ার খবরটিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানা আঙ্গিকে উপস্থাপন করে বানানো হয়েছে ‘নকল’ পত্রিকাগুলো। ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকের কাছেই পৌঁছে যায় পত্রিকাগুলোর নকল সংস্করণ। সেখানে প্রধান বিচারপতি ও সরকার নিয়ে মনগড়া তথ্য-সংবলিত খবর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতারণার এ ঘটনা ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। এরই মধ্যে এ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর, সংবেদনশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জড়িয়ে পত্রিকার মাস্টহেড নকল করে এমন গুজব ছড়ানো ভয়ঙ্কর ঘটনা। নকলে পৃথিবী সয়লাব। ফেসবুকে নকল বা ফেক আইডি চোখে পড়ে অহরহ। এমনটি নকল লাইকেরও বন্যা বয়ে যায়। গবেষকরা জানিয়েছেন, ‘কলিউশন নেটওয়ার্ক’-এর মাধ্যমে বিনামূল্যে কোটি কোটি নকল লাইক পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। এই নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত হতে আপনার অ্যাকাউন্টের প্রায় সব অ্যাকসেস গ্র্যান্ট করে নিজেও প্রতারণার কব্জায় আটকে পড়ছেন কেউ কেউ।

নকল ও নিম্নমানের সিসি ক্যামেরা : নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে গত কয়েক বছরে সরকারি-বেসরকারিভাবে সিসি ক্যামেরার ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। বাসাবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে, এমনকি রাস্তাঘাটেও লাগানো হচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরা। শুধু রাজধানী নয়, দেশের সব জেলা শহর, পৌর সদরেও সিসি ক্যামেরার ব্যবহার বেড়ে গেছে। কিন্তু সিসিটিভি ব্যবহারের কাঙ্ক্ষিত সুফল কি পাওয়া যাচ্ছে? নাকি এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই অকেজো প্রদর্শনীর বিষয় হয়ে পড়েছে? নামেই যেন ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা বা সিসিটিভি। ভিডিও ফুটেজে সবকিছুই ঝাপসা, অস্পষ্ট আর অন্ধকারাচ্ছন্ন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, স্যামসাং থেকে শুরু করে ডাহুয়া, এইচআইকেভিশন, ক্যামপ্রো, এভিটেকসহ প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব ব্র্যান্ডের নকল সিসি ক্যামেরা বাজারে অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। মূলত চীন থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামাঙ্কিত নকল সিসি ক্যামেরা আনা হয়। আমদানির পর দেশেই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লেবেল ও মোড়ক লাগিয়ে বাজারজাতের ঘটনা ঘটছে। ঢাকার এমন কিছু মার্কেট আছে, যেখানে মাত্র এক-দেড় হাজার টাকায়ও নিম্নমানের সিসি ক্যামেরা পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দায়সারাভাবে এসব নিম্নমানের সিসিটিভি ব্যবহার করে।

চোরাই ও নকল মোবাইল সেট : ঢাকা শহরের নামিদামি শপিং সেন্টার থেকে বিক্রি হচ্ছে চোরাই ও নকল মোবাইল সেট। আর মোটা অঙ্কের টাকায় নামিদামি ব্র্যান্ডের নামে নকল ও চোরাই মোবাইল কিনে প্রতারণা আর হয়রানির শিকার হচ্ছেন ক্রেতাসাধারণ। এসব মার্কেটের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ছিনতাই ও চোরচক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নামিদামি মোবাইল সেট অল্প টাকায় ক্রয় করে থাকে। পরে অধিক মুনাফা লাভের আসায় নকল আইএমইআই নম্বর দিয়ে চড়া মূল্যে বিক্রি করে সেগুলো। ওই মোবাইল সেট ক্রয় করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নাজেহাল হতে হয় ক্রেতাসাধারণকে। বিভিন্ন শপিং মলে প্রায়ই র‌্যাবের অভিযানে বিপুল পরিমাণ চোরাই ও নকল মোবাইল সেট উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়।

জোহরার নকল চেক কারবার : নকল চেকে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের ‘ভয়ঙ্কর’ জালিয়াত চক্র ধরা পড়েছে সিলেটে। আর ওই চক্রের হয়ে গোটা দেশের ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় টাকা তুলতেন জোহরা ওরফে শারমিন নামের এক মহিলা। বোরকা পরিহিত ওই মহিলা যখন ব্যাংকে যেতেন আগেই বাইরে থেকে ইন্টারনেটে মেসেজের মাধ্যমে ফরোয়ার্ডিং দিয়ে রাখত প্রতারক চক্রের সদস্যরা। এভাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি শতাধিক ব্যাংকের শাখা থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের সিলেট করপোরেট শাখার এজিএম মো. ইমরান উল্লাহ জানিয়েছেন, নকল চেকে টাকা উত্তোলন প্রতারক চক্রের কারণে গোটা দেশের ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। ওদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে গোটা দেশে। তারা ব্যাংকের চেকবই পর্যন্ত তৈরি করে থাকে।

নকল মাদকে সয়লাব : সারা দেশে ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা নকল হচ্ছে। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, এখন পর্যন্ত ঢাকাতেই অন্তত ইয়াবার ছয়টি নকল কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। ঢাকায় লাখ লাখ ইয়াবাসেবীর একটা বড় অংশই নকল ইয়াবা ব্যবহার করছে। আকার, রং, গঠন একই রকম হওয়ায় ইয়াবাসেবীরা কোনটা আসল কোনটা নকল তা বুঝতে পারে না। সূত্র জানায়, নকল ইয়াবা ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে ইয়াবার আকারে নানা ধরনের ট্যাবলেট কিনে তাতে রং আর ইয়াবার গন্ধ মিশিয়ে বিক্রি করছে। এ ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ও ব্যথার ট্যাবলেট বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলালকৃষ্ণ সাহা জানান, বিভিন্ন সময় রাসায়নিক পরীক্ষাতেও উদ্ধার করা বেশির ভাগ ইয়াবায় মূল উপাদান পাওয়া যায়নি। ইয়াবা ছাড়া ফেনসিডিলও নকল হচ্ছে দেশেই। পরীক্ষা প্রতিবেদনে নকল ইয়াবা ও নকল ফেনসিডিল প্রমাণিত হওয়ায় মামলারও মেরিট থাকে না। এতে সহজেই মুক্তি পায় মাদক ব্যবসায়ীরা। একাধিক সূত্র দাবি করেছে, দেশের কয়েকটি এনার্জি ড্রিঙ্কস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইয়াবা ট্যাবলেট বানানোর চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে ছোটখাটো কিছু ওষুধ কোম্পানিও ইয়াবা ট্যাবলেট বানাচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর