সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দেশের সম্মান বাড়াতে কাজ করুন

রোহিঙ্গা নিয়ে এত বড় কূটনৈতিক সাফল্য আগে হয়নি, ঢাকায় দূত সম্মেলন উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

দেশের সম্মান বাড়াতে কাজ করুন

প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের নিয়ে তিন দিনের দূত সম্মেলন গতকাল ঢাকায় শুরু হয়েছে। সম্মেলনের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়াটা বাংলাদেশের জন্য বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ সমর্থন দিয়েছে, সাধুবাদ জানিয়েছে। তারা জানতে চাচ্ছে— কী কী লাগবে। তারা সব করতে রাজি আছে। বাংলাদেশ বোধ হয় আর কোনো দিনই এত বড় কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করতে পারে নাই।’ প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে রাজনৈতিক কূটনীতির পরিবর্তে অর্থনৈতিক কূটনীতি পরিচালনার মাধ্যমে দেশের সম্মান বৃদ্ধিতে কাজ করার জন্য রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের প্রতি আহ্বান জানান। বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষা, দেশে আরও বিনিয়োগ আনা, নতুন রপ্তানি বাজার সৃষ্টি, জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি, প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। উদ্বোধনের পর তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সেশনে রাষ্ট্রদূতদের নির্দেশনা দেন মন্ত্রী-উপদেষ্টা ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির বিভিন্ন দিকের সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেন রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা।

রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে দূত সম্মেলনের উদ্বোধনী ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যে  কোনো সমস্যার দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। ১৯৯৮ সালে আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কেন আমাকে তৃতীয় কাউকে ডাকতে হবে?’ রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্মতিপত্র স্বাক্ষর হওয়া বিরাট সাফল্য। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে অন্তত একটা সমঝোতা করতে পেরেছি, যার মাধ্যমে আমরা আশা করি, অন্তত এই মিয়ানমারের নাগরিকদের ফেরত পাঠাতে পারব। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, কোনো সন্দেহ নেই তারপরও যেহেতু প্রতিবেশী দেশ, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমরা একটা ভালো সদ্ভাব  রেখে এই সমস্যার সমাধান করতে চাই। রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমিতে ফেরত পাঠাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশে কূটনীতিকদের সক্রিয় থাকার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই অর্থনৈতিক কূটনীতির ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ডিপ্লোমেসিতে আগে পলিটিক্যাল বিষয়টি গুরুত্ব পেত। এখন ইকোনমিক ডিপ্লেমেসি চালু হয়ে গেছে। আমরা কীভাবে কোন কোন দেশে পণ্য পাঠাতে পারি সে বিষয়গুলোও দেখতে হবে। বিদেশে পালিয়ে থাকা জাতির পিতার খুনি এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে। অপপ্রচার করে তারা যেন দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে না পারে। পঁচাত্তরের পর তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে অনেক অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছে, তারা বসে নেই। তারা বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র করছে, অপপ্রচার চালাচ্ছে। প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করার তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেন কোনো রকম হয়রানির শিকার না হন। প্রবাসে যারা আছেন তাদের ভালো-মন্দ দেখা। তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করা। সপ্তাহে কিংবা মাসে একবার প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে বসে তাদের সমস্যার কথা শোনা এবং সমাধান করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এটা ভুলে গেলে চলবে না; তারাই কিন্তু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করেন। তারা যে টাকা পাঠায় এটাই আমাদের রিজার্ভের বড় অংশ। আমরা যে এতগুলো কূটনৈতিক মিশন চালাচ্ছি, এর সিংহভাগ কন্ট্রিবিউশন তারাই করছে। আমি আবারও বলব, প্রবাসী বাঙালিরা যেন হয়রানির শিকার না হন। তাদের সঙ্গে মানবিক দৃষ্টি দিয়ে আচরণ করবেন। তাদের আস্থার জায়গায় নেবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বক্তব্য দেন।

দিনভর আলোচনা : ‘২০২১ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া এবং এসডিজি বাস্তবায়ন’ শীর্ষক সেশনে অংশ নেন রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঞ্চালনায় এ সেশনে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, এসডিজি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম। মধ্যাহ্ন বিরতির পর জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইমতিয়াজ আহমেদের সঞ্চালনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে বক্তব্য দেন রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। বিকালে বাংলাদেশের বাণিজ্য, বিনিয়োগের সুযোগ ও বাধা নিয়ে ওয়ার্কিং সেশনে বক্তব্য দেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম ও বাণিজ্য সচিব সুভাশীষ বসু। প্রত্যেক সেশনে মডারেটর ও প্যানেলিস্টদের বক্তব্যের পর ওপেন সেশনে বক্তব্য দেন রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা।

আজকের কর্মসূচি : আজ দিনের শুরুতে ব্লু ইকোনমি ও কানেকটিভিটি বিষয়ে সেশনে অংশ নেবেন রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা। চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ফজলুল করিমের সঞ্চালনায় এ সেশনে প্যানেলিস্ট হিসেবে থাকবেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম ইউনিটের সচিব খুরশেদ আলম, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আবদুস সামাদ ও গ্রিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জসিম উদ্দিন। শ্রম অভিবাসনের ইস্যু ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে সেশনে মডারেটর হিসেবে থাকবেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। বক্তব্য দেবেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. নমিতা হালদার, সৌদি আরবের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ, আরব আমিরাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। মধ্যাহ্ন ভোজের সময় বিশেষ সেশনে  রোহিঙ্গা সংকটে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কূটনীতি বিষয়ে রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফ করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী এবং মডারেটর হিসেবে থাকবেন মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হবেন রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা।

দিনের শেষ সেশনে আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলো সম্পর্কে বিশেষ সেশনে মডারেটর হিসেবে থাকবেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন, জেনেভায় জাতিসংঘের সদরদফতরে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি শামীম আহসান, ইইউতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শাহাদাত হোসাইন, নেদারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মোহাম্মদ বেলাল এবং অস্ট্রিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবু জাফর। আগামীকাল এ সম্মেলন শেষ হবে।

সর্বশেষ খবর