সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
নির্বাচনী ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন

ভোটের আগেই বরাদ্দের উদ্যোগ

গোলাম রাব্বানী

ভোটের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বরাদ্দের টাকা দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে সিংহভাগ ব্যয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা খাতে হলেও বরাদ্দের টাকা বিলম্বে দিলে নানা জটিলতা হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ক্ষেত্রে বিলম্বে অর্থ বরাদ্দ ও বদলির কারণে নিরাপত্তা সদস্যদের টাকা পেতেও সমস্যা হয়। বিশেষ করে ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তায় থাকা সদস্যরা ভোটের আগে যদি অর্থ বরাদ্দ না পান তবে নির্বাচন ‘প্রভাবিত’ হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় ভোটের আগেই দ্রুততম সময়ে অগ্রিম অর্থ বরাদ্দের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অর্থ বরাদ্দ-সংক্রান্ত সভায় ইসি সচিবালয়ের তৈরি করা কার্যবিবরণী থেকে ভোটের অর্থ নিয়ে সার্বিক চিত্র পাওয়া গেছে। ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত কার্যবিবরণী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর, অর্থ বিভাগ, আনসার ও ভিডিপি, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও র‌্যাবের শীর্ষ ব্যক্তির কাছে পাঠানো হয়। বৈঠকে ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, নির্বাচনী ব্যয়ের প্রায় ৮০ ভাগ অর্থ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা খাতে ব্যয় হয়। ভোটের দায়িত্ব পালনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রায়ই বিভিন্ন জেলা থেকে দায়িত্ব পালন করতে আসেন। আবার ভোটের পর বিভিন্ন জায়গায় বদলিও হয়ে যান। ফলে নির্বাচনের পরে অর্থ বরাদ্দ করা হলে তা দায়িত্ব পালনকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রাপ্তির বিষয়টি অনিশ্চিত। তিনি বলেন, সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচন, উপনির্বাচনে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনের পরে অর্থ বরাদ্দ পান। এ বরাদ্দকৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী যথাযথভাবে পান কি না এবং বাহিনীর অর্থ বরাদ্দ কীভাবে গতিশীল করা যায় তা নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে পন্থা নির্ধারণে ইসি নির্দেশ দিয়েছে।

ইসির কর্মকর্তারা জানান, সর্বশেষ দশম সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি কেন্দ্রে ১৪ থেকে ১৬ জন নিরাপত্তারক্ষী দায়িত্ব পালন করেন। আর র‌্যাব, বিজিবি ও সেনা সদস্যরা ছিলেন টহলে। এ নির্বাচনে ১৪৭ আসনে ভোট হয়। এর আগে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন একক প্রার্থীরা। এ নির্বাচনে প্রায় ২৬৫ কোটি টাকার মধ্যে ১৮৩ কোটি টাকাই ব্যয় হয়েছে আইনশৃঙ্খলা খাতে। পুরো ৩০০ আসনে নিরাপত্তা সদস্য এর দ্বিগুণ হয়ে থাকে। বর্তমান ইসির অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচন হবে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারি ২০১৯-এর মধ্যে। আনসার ও ভিডিপি পরিচালক (অপারেশনস) বলেন, অঙ্গীভূত আনসাররা নির্দিষ্ট হারে ভাতা পান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী সব ভোট কেন্দ্রে নির্দিষ্টসংখ্যক আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়। ভোট কেন্দ্রে আনসার বাহিনীর সদস্যসংখ্যা এবং ভাতা নির্ধারিত থাকে। কিন্তু পরিপত্র জারির পর সময় কম থাকায় ভোটের আগে অনেক ক্ষেত্রেই অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায় না। ভোটের আগেই কেন্দ্রে নিয়োজিত আনসারদের ভাতাদি অগ্রিম বরাদ্দের অনুরোধ জানান এই কর্মকর্তা। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের অনুকূলে নির্বাচনী ব্যয় বাবদ অর্থ বরাদ্দের অনেক উন্নতি হয়েছে। ভোটের আগে বা পরে যখনই অর্থ বরাদ্দ হোক না কেন, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী প্রতিটি পুলিশ সদস্যকে তাদের প্রাপ্য পরিশোধ করা হয়। এখানে ব্যতিক্রমের সুযোগ নেই। মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন পরিদর্শনকালে দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্যরা ভোটের আগে বরাদ্দ পান না বলে উল্লেখ করেন। এতে করে তারা কোনো কোনো সময় স্থানীয় ব্যক্তিদের দেওয়া খাবার খেয়ে থাকেন। ফলে তাদের প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ থেকে যায় বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা। অন্য এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী প্রতিটি সদস্যকে কমন সার্টিফিকেটের (সিসি) ভিত্তিতে প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ করা হয়। এখানে বরাদ্দকৃত অর্থ না পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি জানান, ভোটের আগে পুলিশ সদস্য ও প্রিসাইডিং অফিসারসহ ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা অগ্রিম অর্থ বরাদ্দ পেয়ে থাকেন। কিন্তু আনসার সদস্যরা অর্থ পান না। ফলে অনেক সময় প্রিসাইডিং অফিসার বা ভোট কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে আনসার সদস্যদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আনসার সদস্যদের ভাতাদি ভোটের আগেই অগ্রিম দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনার যুগ্ম-সচিব জানান, ভোটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আনসারই বেশি থাকে। তাদের অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

র‌্যাব-বিজিবিতে বদলি নিয়ে সমস্যা : বিজিবি সদর দফতরের পরিচালক (অপারেশনস) জানান, এই বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনে ভোটের আগে-পরে চার দিন দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাদের নিজ দফতরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে যেতে ও ফিরতে (আসা-যাওয়াসহ) ছয় দিনের অর্থ বরাদ্দের অনুরোধ জানান তিনি। নির্বাচনের পর অর্থ পাওয়া গেলে বকেয়া অর্থ বিজিবি সদস্যদের মধ্যে দিতে অসুবিধার সম্মুখীন হন বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা। র‌্যাবের উপপরিচালক (অপারেশনস) জানান, প্রতি জেলায় র‌্যাবের কার্যালয় না থাকায় বিজিবির মতো তাদেরও দূরবর্তী বিভিন্ন জায়গা থেকে গিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। ভোটের আগেই অগ্রিম বরাদ্দের অনুরোধ জানান তিনি। এ ছাড়া সাত বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র‌্যাব গঠিত। ফলে নির্বাচনের পর অর্থ বরাদ্দ করা হলে ও নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকারী কোনো সদস্য নিজ বাহিনীতে চলে গেলে তাদের বকেয়া অর্থ পরিশোধ করা খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।

দ্রুত ও আগাম বরাদ্দের উদ্যোগ : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম-সচিব (রাজনৈতিক-১) বলেন, ইসির অনুমোদনের পর জননিরাপত্তা বিভাগ পরিপত্র জারি করে। ফলে পরিপত্রটি অনেক সময়ই নির্বাচনের পাঁচ-সাত দিন আগে জারি করা যায়। এজন্য আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বৈঠকটি তফসিল ঘোষণার পরপরই করা যায় কি না তা ভেবে দেখা দরকার। সভায় ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি সদস্য যেন তাদের প্রাপ্য অর্থ হাতে পেয়ে হাসিমুখে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে পারেন তা সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে। সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, নিরাপত্তা সদস্যদের অর্থপ্রাপ্তি সুচারু করতে ইসি সচিবালয় পাঁচটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলো হলো— পরিপত্র আরও আগে জারি করা; বাহিনীর সদস্যদের প্রাপ্য ভাতাদি নির্বাচনের আগেই অগ্রিম দেওয়া; সরাসরি অর্থ বরাদ্দ চেয়ে ইসি সচিবালয়ে পাঠানো ও অনুলিপি জননিরাপত্তা বিভাগে দেওয়া; মোতায়েনের চাহিদাপত্র জনবিভাগে প্রেরণ ও বাহিনীর সদর দফতরে পাঠানো নিশ্চিত এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া।

সর্বশেষ খবর