রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ফিরছেন রহস্যজনক নিখোঁজরা

সর্বশেষ উদ্ধারের পর রিমান্ডে কল্যাণ পার্টির মহাসচিব

মাহবুব মমতাজী

ফিরছেন রহস্যজনক নিখোঁজরা

আমিনুর রহমান

রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ ব্যক্তিরা ফিরে আসতে শুরু করেছেন। দীর্ঘদিন নিখোঁজ থেকে চলতি বছর ঘরে ফিরেছেন অন্তত ১১ জন। তবে তাদের বড় একটি অংশের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি বলে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর অভিযোগ আছে। গত এক সপ্তাহে সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, রাজনীতিবিদসহ তিনজনের খোঁজ মিলেছে। ১৯ ডিসেম্বর রাতে বাড়ি ফেরেন নিখোঁজ সাংবাদিক উৎপল দাশ। এর দুই দিন পর খোঁজ মেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান সিজারের। সর্বশেষ গতকাল খোঁজ মিলল চার মাস নিখোঁজ থাকা কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমানের। তবে তাকে গতকালই গুলশানের একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ। আদালত চার দিন মঞ্জুর করে।

এই কয়েকটি ঘটনা ছাড়াও আরও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। হঠাৎ করেই অনেকে উধাও হয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ দিন বা মাস শেষে আবার ফিরছেন। কেউ কখনই ফিরছেন না। কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ আসছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সংস্থাই তা স্বীকার করে না। কিন্তু তাদের উদ্ধারে সংস্থাগুলোর দৃশ্যত কোনো তৎপরতাও দেখা যায় না। যারা ফিরছেন তাদের বেশির ভাগই মুখ খোলেন না। কীভাবে তাদের তুলে নেওয়া হয়েছিল, কোথায় রাখা হয়েছিল বা যারা নিয়েছিল তাদের নাম-পরিচয় জানতে চাইলে কোনো উত্তর নেই। অনেকে অসুস্থতার কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে নিখোঁজের নেপথ্য কারণও রহস্যাবৃতই থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি ফিরে আসা দুজনের দাবি, অপহরণকারীরা তাদের কাছে টাকা চেয়েছিল। কে এই অপহরণকারী? মুক্তিপণ না নিয়ে কেনই বা ছেড়ে দিয়েছে? এমন প্রশ্নে অস্বস্তি ও শঙ্কা বিরাজ করছে সাধারণ মানুষের মনে। পুলিশ বলছে, যারা নিখোঁজ হচ্ছেন তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়। আবার অনেকেই নিজ থেকে ফিরে আসেন। তবে গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের লোকজনই অপহরণের শিকার হয়েছেন বেশি। দু-একটি ঘটনা ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৫২ জনের নিখোঁজের তথ্য পাওয়া গেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিসংখ্যান থেকে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ২২ আগস্টের পর থেকে ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, প্রকাশক, রাজনীতিক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ অন্তত ১০ জন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। ৭ নভেম্বর নিখোঁজ হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মুবাশ্বার হাসান সিজার, ১০ অক্টোবর নিখোঁজ হন অনলাইন নিউজ পোর্টাল পূর্ব-পশ্চিম বিডি ডট নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার উৎপল দাশ। দুজনই ফিরে এসেছেন। সর্বশেষ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এ এম এম আমিনুর রহমানের খোঁজ মেলে শুক্রবার রাতে। ২০১৫ সালের একটি মামলায় রাজধানীর শাহজাদপুরে প্রগতি সরণি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানায় পুলিশ। তার আগে খোঁজ পাওয়া মিঠুন চৌধুরী ও অজিত কুমার দাশ নামে আরও দুই রাজনীতিবিদকে গ্রেফতার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। তাদের বিষয়ে ডিবি কর্মকর্তারা জানান, সরকারবিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে মিঠুন ও অজিতকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়। মিঠুন চৌধুরীর বিরুদ্ধে সিলেটে চারটি সাজাপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট এবং আরও তিনটি মামলার ওয়ারেন্ট রয়েছে। সাতটি ওয়ারেন্ট মাথায় নিয়ে পরিবারকে না জানিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। এ ঘটনার পর ১৬ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের আধুনিক মর্গ উদ্বোধনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছিলেন, যারা নিখোঁজ হয়েছেন তারা ফিরে আসবেন। নয় তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের খুঁজে বের করবে। এ ছাড়া নিখোঁজ হওয়ার সাড়ে সাত মাস পর বাড়ি ফেরেন ডা. ইকবাল মাহমুদ। কে বা কারা ৩১ মে তাকে তার বাসার সামনে ফেলে রেখে যায়। তবে নিখোঁজের বিষয়ে তিনি মুখ খুলতে চাননি। এক দিন আগে মতিঝিল থেকে নিখোঁজ হন নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার প্রদীপ কুমার সাহা। পরে তার পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে দুর্বৃত্তরা। কিন্তু ২ জুন তাকে নতুন এয়ারপোর্ট সড়ক থেকে উদ্ধার করা হয়। রাজধানীর বনানী থেকে একসঙ্গে নিখোঁজ হওয়া চার যুবকের মধ্যে বরিশালের বাবুগঞ্জের মেহেদির পর ২৯ মে ফিরে আসেন একই এলাকার সুজন ঘরামি (২৭)। এর আগে ১৮ এপ্রিল বি এম কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মেহেদি হাসান নিখোঁজের চার মাস ১৮ দিন পর বাড়ি ফেরেন। গত বছরের ১ ডিসেম্বর নিখোঁজ হয়েছিলেন বাবুগঞ্জ উপজেলার দেহেরগতি ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামের নয়ঘর এলাকার আনিসুর রহমানের ছেলে সুজন। মেহেদি, পাবেল, সাফায়াত তারা চার বন্ধু বনানীর একটি ক্যাফেতে নাস্তা খেয়ে রাস্তায় বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন। তাদের বন্ধু নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাফায়াত হোসেন ও জাইন হোসেন খানের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। ২২ মে রাজধানীর আদাবর থানার ৫ নম্বর রোডের ৭ নম্বর বাড়ি থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মো. সাদেকুল ইসলাম মিলনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। নিখোঁজের দুই মাসের মাথায় ২৩ জুলাই বান্দরবানের একটি এলাকায় রাস্তার পাশে চোখ বাঁধা অবস্থায় মিলনকে পাওয়া যায়। তার আগে মিলনের নিজস্ব নম্বর থেকে তার মায়ের কাছে ফোন করে ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। ২৭ আগস্ট গুলশান থেকে ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায় নিখোঁজ হন। ঘটনার ৭৯ দিন পর বাড়ি ফেরেন এই ব্যবসায়ী ও বেলারুশের অনারারি কনসাল। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম-কমিশনার আবদুল বাতেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকা একজনকে খুঁজে বের করেছে পুলিশ। বাকিরা কোথা থেকে এসেছেন সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তবে সেগুলোর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।

এখনো যাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি : ২২ আগস্ট বনানী থেকে ব্যবসায়ী সৈয়দ সাদাত আহমেদ ও ২৬ আগস্ট ধানমন্ডি থেকে নিখোঁজ শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদের এখনো কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। পাবনা মেডিকেল কলেজের ছাত্র তানভীর আহম্মেদ (তনয়) গত বছর ২৯ নভেম্বর পাবনা থেকে নিখোঁজ হন। তার সঙ্গে ছাত্রলীগের পাবনা মেডিকেল কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরও নিখোঁজ হয়েছিলেন। ১০ দিন পর তাকে শাহবাগ থেকে উদ্ধার করা হয়। গত বছরের ১৪ জুলাই ইয়াসিন মোহাম্মদ তালুকদার বনানী রেলস্টেশন থেকে নিখোঁজ হন। ঘটনার প্রায় দেড় বছরেও সন্ধান মেলেনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ নাগরিকের। ঘটনার পরই ইয়াসিনের মা ডা. সুরাইয়া পারভিন ভাসানটেক থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ছেলের জন্য পাগলপ্রায় মা ডা. সুরাইয়া পারভিন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ছেলে আমার দীর্ঘদিন লাপাত্তা। তাকে পাব কিনা আল্লাহই ভালো জানেন।’ গত বছরের ৫ ডিসেম্বর কলাবাগান থেকে নিখোঁজ হন এ লেভেলের ছাত্র সাঈদ আহমেদ খান। মিরপুর থেকে ও লেভেল পাস করা দুই ভাই আহমেদ রাফিদ আল হাসান ও আয়াদ হাসানও নিখোঁজ আছেন। ঢাকা কলেজের পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আকরাম হোসেনও (২৫) নিখোঁজ। গত বছরের ১৮ জানুয়ারি বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন মো. জাকির হোসেন। একটি কারখানায় বিদ্যুতের সকেট বানানোর কাজ করতেন তিনি। তখন থেকেই নিখোঁজ। দুই বছরের বেশি সময় ধরে শাহরিয়ার খান নামের আরেক যুবক নিখোঁজ রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর