রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ১১৩

গ্রেনেডটি ছিল কাশ্মীর যুদ্ধের

মির্জা মেহেদী তমাল

গ্রেনেডটি ছিল কাশ্মীর যুদ্ধের

ওরা চারজন— বদরুল আলম মিজান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল ওরফে মোহাম্মদ বদরুল, মিজানুর রহমান মিজান ওরফে মিঠু। হবিগঞ্জ বৈদ্যের বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে ওতপেতে বসে আছে। মিঠুর হাতে একটি আর্জেস গ্রেনেড। তিনি স্কুল গেটের সামনের রাস্তার পশ্চিম পাশে দাঁড়ানো। মোহাম্মদ বদরুল রাস্তার পুবদিকে। কাছের চায়ের স্টলের কাছে একটি মোটরসাইকেল দাঁড় করানো। তার ওপর বসে আছে বদরুল আলম মিজান এবং মোহাম্মদ আলী। এই চারজনের নিশানা এমন এক ব্যক্তির ওপর যিনি শুধু দেশেই নন, আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যার মিশন নিয়ে ওরা চারজন দুপুর থেকেই শক্তিশালী গ্রেনেড নিয়ে অপেক্ষায়। তাদের কাছে খবর আছে, সন্ধ্যাতেই আসবেন তিনি। তাদের অপেক্ষারও সমাপ্তি ঘটবে। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি দুপুর থেকে দুর্ধর্ষ চার অপরাধী অপেক্ষায় রয়েছে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার জন্য। দুপুর গড়িয়ে বিকাল। সবাই প্রস্তুত। আর কিছুক্ষণ পরই আসবেন তিনি। চারজনই যে যার অবস্থান নিয়ে আছেন। কিন্তু হঠাৎ মত পাল্টালেন মিঠু। গ্রেনেড নিয়ে ফিরে এলেন চায়ের স্টলে মোটরসাইকেলের কাছে। ‘আমি পারব না গ্রেনেড মারতে।’ সাফ জানিয়ে দিলেন মিঠু। মিঠুর কথা শুনে হতাশ বদরুল। ‘দেখ আমার মাথায় খুন উঠে গেছে। পারব না, বলা যাবে না। এখান থেকে ফেরত যাওয়া যাবে না।’ বোঝাতে থাকেন বদরুল। তবুও রাজি নন মিঠু। বদরুলও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। ‘তোরা চলে যেতে চাইলে, চলে যা, আমি একাই এই কাজ শেষ করব।’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানান বদরুল। সন্ধ্যা হয়। জনসভা শুরু হয়। জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া। সভাস্থল থেকে হাস্যোজ্জ্বল কিবরিয়া নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসতে থাকেন স্কুল গেটের পাশে। আর তখনই ঘটল বিস্ফোরণ। বদরুল আলম মিজান নিজেই ছুড়ে মারলেন গ্রেনেড। একদম সাবেক অর্থমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে মারা আর্জেস গ্রেনেডটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো। মুহূর্তের মধ্যে ছিটকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব কিবরিয়া। আরও লুটিয়ে পড়লেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী আবদুর রহিম, ছিদ্দিক আলী ও আবুল হোসেন। এ ছাড়া হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু জাহির এমপি, অ্যাডভোকেট আবদুল আহাদ ফারুক, আবদুল্লাহ সরদার, সাংবাদিক সুহাইল আহমেদসহ আহত হন ৭০ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকলেন কিবরিয়াসহ অন্যান্য আহতরা। হামলা করেই মোটরসাইকেল নিয়ে চম্পট ঘাতকরা।

হামলার ঘটনার পরদিন হবিগঞ্জ সদর থানায় একটি হত্যা ও একটি বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়। মামলায় সর্বশেষ গত ২০১৪ সালের নভেম্বরে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী (আরিফুল ইসলাম চৌধুরী), হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও হবিগঞ্জ পৌর মেয়র গোলাম কিবরিয়া (জি কে গউছ)-সহ ১১ জনকে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে তৃতীয়বারের মতো সম্পূরক চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। ৯ বছর ৯ মাস ১৬ দিন পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিলেটের সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মেহেরুন্নেছা এ চার্জশিট দাখিল করেন। মামলায় আগে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত ইউসুফ বিন শরীফ, আবু বক্কর আবদুল করিম ও আহছান উল্লাহকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি প্রদানের আবেদন জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এর আগের চার্জশিটে ১০ জন ও দ্বিতীয় দফা আরও ১৪ জনকে সংযুক্ত করে ২৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। চার্জশিটে নতুন অন্তর্ভুক্ত ১১ জন হলেন— খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী (আরিফুল ইসলাম চৌধুরী), হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও হবিগঞ্জ পৌর মেয়র গোলাম কিবরিয়া (জি কে গউছ), মুফতি সফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, তাজউদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া।

খুনের পরিকল্পনা : আওয়ামী লীগ নেতাদের ঈদ-পুনর্মিলনী ও রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠানের জন্য ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করা হয়। আর অনুষ্ঠানস্থল হিসেবে হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্ধারণ করা হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে সাবেক অর্থমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য শাহ এ এম এস কিবরিয়া উপস্থিত থাকবেন। এমন সংবাদ পাওয়ার পর শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল হবিগঞ্জ শহরের চৌধুরী বাজারের বদরুল আলম মিজানকে ওই সভায় গ্রেনেড হামলার নির্দেশ দেন। তাদের টার্গেট সাবেক অর্থমন্ত্রী। নির্দেশ মতো ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি বদরুল আলম মিজান তার নিজের লাল রঙের মোটরসাইকেলটি ভগ্নিপতি মাওলানা কুতুব উদ্দিনের বাসা থেকে সংগ্রহ করেন। মোটরসাইকেলে তার পরিচিত রুহেল মাস্টারকে নিয়ে সুনামগঞ্জের হাফেজ নিমুর দোকানের কাছে যান এবং দোকানের কাছেই মোটরসাইকেলসহ রুহেল মাস্টারকে দাঁড় করিয়ে রাখেন। বদরুল আলম মিজান হাফেজ নিমুর কাছ থেকে ১টি গ্রেনেড নিয়ে মোটরসাইকেলের কাছে ফিরে আসেন। রুহেল মাস্টারকে গ্রেনেডটির কথা না জানিয়ে তাকে গ্রেনেডসহ ব্যাগটি রাখতে বলেন। বদরুল আলম মিজান মোটরসাইকেল চালিয়ে হবিগঞ্জ চলে আসেন। হবিগঞ্জ উমেদনগর টাইটেল মাদ্রাসার কাছে এসে রুহেল মাস্টারকে চলে যেতে বলেন। রুহেল মাস্টার তাকে ওই ব্যাগের কথা জিজ্ঞাসা করেন। তখন মিজান রুহেলকে নিয়ে উমেদনগর মাদ্রাসার দোতলায় যান এবং রুহেলকে গ্রেনেডটি দেখান। পরবর্তীতে বদরুল আলম মিজান গ্রেনেডসহ তার বাসা চৌধুরী বাজারে যান এবং তার রুমের একটি ট্রাঙ্কে তার বই-খাতার মধ্যে গ্রেনেডটি রেখে দেন। এর ৪-৫ দিন পর মিজান বেলা ১১টার সময় মিজান (মিঠু), মোহাম্মদ আলী, বদরুলদের মোবাইল করে উমেদনগর মাদ্রাসায় আসতে বলে এবং ৪ জনে চৌধুরী বাজার বানিয়াচং হোটেলে বসে বৈদ্যের বাজারে শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সভায় গ্রেনেডটি মারবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বেলা ৩টায় উমেদনগর মাদ্রাসা থেকে বদরুল আলম মিজান ও মোহাম্মদ আলী মোটরসাইকেলে বৈদ্যের বাজার যায়। বৈদ্যের বাজারে সভার কাছাকাছি জায়গায় তারা একত্রিত হন এবং তারা মোটরসাইকেলটি অস্থায়ী চা-স্টলের পাশে রাখেন। একই সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত সচিব হারিছ চৌধুরী ও অচেনা একজন একটি নীল রঙের মোটরসাইকেলে এসে অস্থায়ী চা-স্টলের পাশে এসে থামেন। হারিছ চৌধুরী লাল রঙের মোটরসাইকেলে আসা লোকদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর হারিছ চৌধুরী ও অচেনা লোকটি কিবরিয়া মিটিং শেষ হওয়ার ২০-৩০ মিনিট আগে ওই নীল রঙের মোটরসাইকেলে করে চলে যান। বদরুল আলম মিজান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল ওরফে মোহাম্মদ বদরুল, মিজানুর রহমান মিজান ওরফে মিঠু একসঙ্গে বৈদ্যের বাজার যান। বদরুল আলম মিজান গ্রেনেডের প্যাকেট থেকে গ্রেনেড বের করে মোহাম্মদ আলীর হাতে দিয়ে কীভাবে ছুড়তে হবে দেখিয়ে দেন। মিঠুকে রাস্তার পশ্চিম পাশে এবং বদরুলকে রাস্তার পুবদিকে দাঁড়াতে বলেন। সভার কাছাকাছি মোটরসাইকেলসহ বদরুল মিজান দাঁড়িয়ে থাকেন। এমন সময় মোহাম্মদ আলী মিজানের কাছে যান এবং তিনি গ্রেনেড ছুড়তে পারবেন না বলে জানালে বদরুল আলম মিজান গ্রেনেডটি নিয়ে নেন এবং সন্ধ্যা অনুমান ৭টার দিকে জনসভা শেষ হওয়ার পর বদরুল আলম মিজান শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে গেটে দেখার সঙ্গে সঙ্গে কিবরিয়াকে লক্ষ্য করে গ্রেনেডটি ছুড়ে মারেন। পরে বিকট আওয়াজ হয় ও তখনই বিদ্যুৎ চলে যায় এবং বদরুল আলম মিজান ঘটনাস্থল হতে দৌড়ে মোটরসাইকেলের কাছে আসেন এবং মোহাম্মদ আলীসহ দ্রুত মোটরসাইকেলে হবিগঞ্জ চলে যান। গ্রেনেড বিস্ফোরণের ফলে শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হন এবং ৭০ জন আহত হন। চার্জশিটে বলা হয়, ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল মুফতি আবদুল হান্নান এক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ২০০৩ সালের শেষের দিকে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরের বেইলি রোডের সরকারি বাসায় অপরাপর আসামিদের সঙ্গে মেয়র জি কে গউছ ও মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে লুত্ফুজ্জামান বাবর সিলেটে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সহায়তায় কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

গ্রেনেডের উৎস : চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, মাওলানা তাজউদ্দিন আর্জেস গ্রেনেড পাকিস্তান থেকে সংগ্রহ করে আনেন। ওই গ্রেনেড কাশ্মীর যুদ্ধে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু সীমান্ত পাহারা জোরদার থাকায় গ্রেনেড পাচার করতে পারেনি তারা। পরে ৩২টি গ্রেনেড তাজউদ্দিনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নেন হুজি নেতা মুফতি হান্নান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে যে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, তা ওই ৩২টি গ্রেনেড থেকে সরবরাহ করেন মুফতি হান্নান। এর মধ্য থেকে সিলেট অঞ্চলে পাঠানো হয় ৯টি গ্রেনেড। এর মধ্যে একটি গ্রেনেড ব্যবহার করা হয় কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডে।

সর্বশেষ খবর