সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী - ১১৪

ব্যয়বহুল দেশত্যাগ

মির্জা মেহেদী তমাল

ব্যয়বহুল দেশত্যাগ

গাজীপুর কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভোর থেকে চারটি দামি গাড়ি পার্ক করা। ছয়-সাত জন অস্থিরভাবে পাঁয়চারি করছেন। সকাল ৮টায় কাশিমপুর-২ কারাগার থেকে বেরিয়ে এলেন এক ব্যক্তি। জিন্সের প্যান্ট আর জ্যাকেট পরা। চোখে সানগ্লাস। দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে লোকটি বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির সামনের লোকগুলোর তৎপরতা  বেড়ে গেল। তারা দৌড়ে লোকটির সামনে গিয়ে সালাম দিলেন। তবে এসব কিছুতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই লোকটির। সানগ্লাসে ঢাকা চোখ ঘুরছে চারপাশে। নাহ! কেউ নেই।  গতি বাড়িয়ে একটি গাড়িতে চড়ে বসলেন। চারটি গাড়ি একসঙ্গে বেরিয়ে গেল কারাগার কম্পাউন্ড থেকে। কারাগারের সীমানার বাইরে অপেক্ষায় ছিল আরও দুটি গাড়ি ও দুটি মোটরসাইকেল। লোকটিকে বহন করা গাড়ির গতি কমে গেল। জানালা দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহীর সঙ্গে কথা বললেন লোকটি। এরপরই ছয়টি গাড়ি ও দুটি  মোটরসাইকেল দ্রুতগতিতে ছুটতে শুরু করল। লোকটি  দেশের শীর্ষস্থানীয় কোনো রাজনৈতিক বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব নন। তিনি  ছিলেন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন। নাম তার বিকাশ। পুরো নাম বিকাশকুমার বিশ্বাস, যাকে লোকজন চেনে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন হিসেবে। ২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে এভাবেই কাশিমপুর কারাগার থেকে বিকাশ বেরিয়ে যান। কিন্তু পুলিশ  গোয়েন্দাদের কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। আর এই দেশ ত্যাগ করতে তাকে পথে খরচ করতে হয়েছে ৫ কোটি টাকা। এতে নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেছেন তারা গন্তব্যস্থলে। গাড়ির বহর নিয়ে স্ত্রীসহ বিকাশ ও তার  দেহরক্ষীরা দুপুরের পরপরই নিরাপদে যশোরে পৌঁছেন।  সেখানে রাতযাপন। পরদিন সকালেই বেনাপোল সীমান্ত হয়ে ভারতের হরিদাসপুর। সেখান থেকে কলকাতা। এভাবেই ব্যয়বহুল দেশত্যাগ ঘটে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই ডনের। যিনি সিরিজ হত্যা, চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য মামলার আসামি। কাশিমপুর থেকে বেনাপোল— এ পর্যন্ত সড়ক নিরাপদ রাখতে বিকাশকে খরচ করতে হয়েছে ৫ কোটি টাকা। সেই বিকাশ কলকাতাও ছেড়েছেন। তিনি এখন আছেন ফ্রান্সে। ফ্রান্সে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন তারই ছোট ভাই প্রকাশ। ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তিনিও একজন অন্যতম সদস্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মামলার নথিপত্র এবং বিকাশ-প্রকাশের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ঠাণ্ডা মাথার খুনি হিসেবে পরিচিত এই বিকাশের ছোট ভাইয়ের নাম প্রকাশ কুমার বিশ্বাস। তাদের বাবার নাম বিমল কুমার বিশ্বাস। বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার শিবনগরে। ঢাকার মিরপুর পাইকপাড়া তাদের বাসা। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার যে শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা করেছিল, তাতে বিকাশ-প্রকাশের নাম ছিল। ওই তালিকার পরই প্রকাশ ভারতে পালিয়ে যান।  সেখানে তিনি আইন বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করেন। বর্তমানে তিনি রয়েছেন ফ্রান্সে। প্রায়ই তাকে সেখানকার বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যায়। সেখানে বেড়াতে যাওয়া পূর্বপরিচিত অনেক বাংলাদেশির আতিথেয়তা মেলে প্রকাশের বাসায়। তবে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হলেও প্রকাশের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। সূত্র জানায়, বিকাশ আর প্রকাশ বর্তমানে ফ্রান্সে থাকলেও তাদের নামে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায় হচ্ছে ঢাকায়। ঢাকা থেকে পাঠানো মোটা অঙ্কের টাকায় তারা ফ্রান্সে আলিশান জীবনযাপন করছেন। আগারগাঁও পিডব্লিউডির টেন্ডার এখনো নিয়ন্ত্রণ করছেন বিকাশ। জলে থাকতেও তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফ্রান্স থকে টেলিফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার সহযোগীদের সঙ্গে। আদেশ-নির্দেশ দিচ্ছেন। সেভাবেই তার শিষ্যরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৫ সালের দিকে পাইকপাড়াকেন্দ্রিক মস্তানি করতেন বিকাশ। সেই সময়ে এশিয়া সিনেমা হলের টিকিট কালোবাজারির প্রধান রমজানকে হত্যা করেন। রমজানকে খুনের মধ্য দিয়েই মূলত তার আন্ডারওয়ার্ল্ডে হাতেখড়ি। রমজান খুন এবং বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তার ছোট ভাই প্রকাশ মিরপুর বাঙ্লা কলেজের তখন ছাত্র। বড় ভাইয়ের এই নামডাকের কারণে প্রকাশ বিভিন্ন স্থানে সমীহ পেতে থাকেন। ধীরে ধীরে তিনিও গপ তৈরি করেন। বড় ভাইকে সহযোগিতা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বিকাশ-প্রকাশ বাহিনী হিসেবে শক্তিশালী বাহিনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে।

সূত্র জানায়, আগারগাঁও পিডব্লিউডির টেন্ডারে হাত বাড়ান বিকাশ-প্রকাশ। বাধা হয়ে দাঁড়ান আরেক সন্ত্রাসী শামীম। পিডব্লিউডির ভিতরই শামীমকে গুলি করে হত্যা করে বিকাশ-প্রকাশ বাহিনী। সঙ্গে শামীমের সহযোগী মামুনও খুন হন।  জোড়া খুনের পর বিকাশ-প্রকাশের নাম আরও ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগ নেতা জরিপকে হত্যার পর বিকাশ আর প্রকাশ এ গ্রেডের অপরাধী হিসেবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে নাম লেখান। মিরপুর, সাভার, ইব্রাহীমপুরসহ আশপাশ এলাকায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েন তারা। হয়ে ওঠেন শক্তিশালী ফাইভ স্টার গ্রুপের সদস্য। এসব ঘটনার পর বিকাশ-প্রকাশ তখন অপরাধ সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট। তাদের অস্ত্রের ভাণ্ডারে অত্যাধুনিক সব ক্ষুদ্রাস্ত্র মজুদ ছিল। গোটা রাজধানীতেই এ বাহিনী ছিল সক্রিয়।

আরও খুন : কারাগারে বন্দী বা মুক্তি-কোনো কিছুই আসে যায় না শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশের জন্য। বাইরে থাকতে যেমন খুন করেছেন, তেমনি জেলে গিয়েও খুনের নির্দেশ দিয়েছেন। এমন বহু খুনের সঙ্গেই তার সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ ও  গোয়েন্দারা। ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত আলী মিস্টার, ব্যবসায়ী নেতা ও প্রিন্স গ্রুপের মালিক কাজী শহীদুল্লাহ, ব্যবসায়ী আহম্মেদ আলী, ব্যবসায়ী আফতাব হোসেন, আবদুল বারেক, ছিন্নমূল মার্কেটের সভাপতি রিপন খান, মাহবুব, সেলিম, গুদারাঘাটের টিপু, ছাইদুল ইসলাম রিপন, পল্লবীতে মত্স্য খামার ব্যবসায়ী হামিদুর রহমান খোকন, বাদশা মিয়া, কল্যাণপুরে মুদি দোকানি রুহুল আমিন, মিরপুরে খাজা মার্কেটের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বিপ্লব, মনিপুরের মুদি দোকানি সেলিম, পল্লবীর বিহারি ক্যাম্পের লবণ ব্যবসায়ী ফকরুদ্দীন আহম্মেদ ও তার ছেলে বাবুল, কল্যাণপুরে ঠিকাদার আবদুল জাব্বার, শিল্পপতি আজহারুল ইসলাম, গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবদুস সামাদ, ভিডিও সেন্টারের মালিক মাহবুব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিকাশের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে দেখা গেছে। পুরস্কার ঘোষণার পর বিকাশকে ১৯৯৭ সালে প্রথম  গ্রেফতার করা হয়। নারায়ণগঞ্জ থেকে তৎকালীন গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম বন্দুকযুদ্ধের পর পাকড়াও করতে সমর্থ হন আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই ডনকে। ওই সময় বিকাশের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগসহ ১২টি মামলা ছিল। ২০০৯ সালের ১৭ জুলাই কাশিমপুর কারাগার থেকে একবার মুক্তি পেয়েছিলেন বিকাশ। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ওই দিনই গাজীপুর থেকে তাকে  ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় (অপরাধে জড়িত সন্দেহে)  গ্রেফতার করে আবার কারাগারে পাঠানো হয়। পরে  তেজগাঁও থানার একটি হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার  দেখানো হয়।

আলোচিত জামিন : বিকাশের এই জামিন নিয়ে নানা মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তবে এর নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধানে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াত  জোট সরকার আমলে বিকাশ ছিলেন জেলে। তখন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ কারাগারে অন্তরীণ। আওয়ামী লীগের ওই রাজনীতিবিদদের মধ্যেই প্রভাবশালী একজন নেতা ছিলেন, যিনি বিকাশের পাশের কক্ষেই ছিলেন। ওই রাজনীতিককে কারাগারের অভ্যন্তরে নানাভাবে নির্যাতন করা হচ্ছিল। খাবার-দাবারও ভালো দেওয়া হতো না।  তেলাপোকাসহ নানা রকম পোকামাকড় থাকত খাবারের ভিতর। ওই নেতা ওই খাবার খেতে পারতেন না। এ খবর জানতে পারেন বিকাশ। তিনি একসময় সুযোগ-সুবিধা মতো ওই নেতার সঙ্গে পরিচিত হন। কথাবার্তা বলেন। নেতাকে তিনি ভালো খাবার-দাবারসহ নানা সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার আগে ওই নেতা তাকে বলেছিলেন, কখনো সুযোগ এলে তিনি এ ঋণ শোধ করবেন। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ওই নেতা পান একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। সে ঋণ শোধ করতেই বিকাশকে জামিনে মুক্তির পর দেশত্যাগে সহায়তা করেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। সূত্র মতে, দেশত্যাগের সময় পথেঘাটে যেন সমস্যা না হয়, সে ব্যবস্থাও আগে থেকে করে রাখা হয়েছিল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর