বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দূরত্ব বাড়ছে এমপিদের সঙ্গে

রফিকুল ইসলাম রনি

দূরত্ব বাড়ছে এমপিদের সঙ্গে

ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বললেন, ‘ভাই! আর পারি না। নয় বছর দলের নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে এমপি সাহেব ব্যস্ত নিজের স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে। একজনকে বানিয়েছেন মেয়র, আরেকজনকে দিয়েছেন দলের দেখভালের দায়িত্ব। এখানে দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা মূল্যহীন।’ এ অবস্থা শুধু ঢাকার পার্শ্ববর্তী উপজেলায় নয়, দেশের শতাধিক আসন-এলাকায়ও একই চিত্র। কর্মীদের মূল্যায়ন নেই। আত্মীয়করণ আর ব্যক্তিকরণ নিয়েই ব্যস্ত এমপিরা। দলের নেতা-কর্মীদের পরিবর্তনে নবাগতদের প্রাধান্য সব ক্ষেত্রে। ফলে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে এমপিদের দূরত্ব বাড়ছে। সূত্রমতে, ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ কর্মীরা অনেকের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে ১০ জন এমপির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছেন নিজ দলের নেতা-কর্মীরা। অনেকের বিরুদ্ধে সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় রয়েছে তৃণমূল। সেদিন জামালপুরের এক নেতা বললেন, ‘এমপি সাহেব উপজেলা যুবদল নেতাকে এনে জেলা কমিটিকে পাশ কাটিয়ে যুবলীগের পৌর সভাপতি বানিয়েছেন। এখন পৌরসভায় দলের প্রার্থীকে ডোবানোর প্রক্রিয়া মজবুত করার কাজে ব্যস্ত এই সাবেক যুবদল ও বর্তমান যুবলীগ নেতা। মেয়র পদে তিনি নিজে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছেন। ক্ষোভের অনল তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মনে।’ আজ সেই পৌরসভায় ভোট হচ্ছে। ওই আওয়ামী লীগ নেতা আরও বললেন, ‘যদি দলের পার্থী পরাজিত হন, তাহলে কাকে দায়ী করব? সাবেক যুবদল ও বর্তমান যুবলীগ নেতাকে না এমপি সাহেবকে?’ এভাবেই চলছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানামুখী কার্যক্রম। অনেক এমপি দলের নেতা-কর্মীদের চাপে রাখতে বিএনপি-জামায়াতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রাজশাহী ও নাটোরের তিনজন এমপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন দলের নেতারা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আওয়ামী লীগ সূত্র জানিয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র এক বছর বাকি। আগামী বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার কথা। এই সময়ে এমপিদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের দ্বন্দ্ব ও বিরোধে উদ্বিগ্ন আওয়ামী লীগ। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ততই বাড়ছে এ উদ্বেগ। বিশেষ করে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের দূরত্বও ভোটের ব্যবধান বড় করে দিয়েছে। বিষয়টি আমলে নিয়ে যে কোনো মূল্যে এ দ্বন্দ্ব দূর করতে চায় ক্ষমতাসীন দল। দলের শীর্ষ নেতারা বার বার মন্ত্রী-এমপিদের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বিরোধ ও দূরত্ব কমিয়ে আনার তাগিদ দিচ্ছেন।

কিছু কিছু এলাকায় এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দূরত্ব আছে স্বীকার করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে ছোটখাটো যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো ছয় মাসের মধ্যে মিটিয়ে ফেলা হবে। দলকে সুসংগঠিত করতে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ইতিমধ্যে কর্মিসভা, বর্ধিত সভা করা হচ্ছে। এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, নির্বাচন পর্যন্ত চলবে।’

তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এমপিদের সঙ্গে দূরত্ব সবচেয়ে বেশি বাড়ছে তৃণমূলের। দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশ কাটিয়ে চলছেন তারা। তাদের অনেক দম্ভ! নেতা-কর্মীরা কোনো কাজে এমপিদের কাছে গেলে চরম দুর্ব্যবহার করেন এবং বলে থাকেন, কেউ কি ভোট দিয়ে এমপি বানিয়েছো? নেত্রী মনোনয়ন দিয়েছেন তাই এমপি হয়েছি। মনোনীত তাই নির্বাচিত এ রকম অর্ধশত এমপি নির্বাচনের পর নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছেন। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগও তারা কমিয়ে দেন। কেউ কেউ ছয় মাস বা এক বছর পর নির্বাচনী এলাকায় গেলেও সরকারি কর্মসূচিতে অংশ নিয়েই ঢাকায় চলে আসেন। ফলে নেতা-কর্মীরা এমপিকে দলীয় কর্মকাণ্ডে পান না। কেউ কেউ এলাকার নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছেন এমন অভিযোগও আছে। এভাবে গত চার বছরে অনেক এমপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, এ দূরত্ব আর ঘোচানো সম্ভব নয়। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে অভিযুক্ত সংসদ সদস্যরা ততই এলাকামুখী হতে গিয়ে স্থানীয়ভাবে বিরোধিতার মুখে পড়ছেন। হবিগঞ্জের এক এমপি বিএনপি-জামায়াতের নাশকতার মামলার আসামিকে আওয়ামী লীগে যোগদান করিয়েছেন। নেতা-কর্মীরা ব্যাপারটির বিরোধিতা করলে নিজ দলের নেতাদের ওপর চালানো হয়েছে নির্যাতনের স্টিম রোলার। চট্টগ্রাম এলাকায় একজন এমপির বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ শুরু থেকেই। তিনি নিজেও জামায়াত ঘরানার ছিলেন। দুটি উপজেলার আওয়ামী লীগের সিংহভাগই তার সঙ্গে নেই। তিনিও দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেন না। দিনাজপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এলাকায় এক এমপিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো। আরেক উপজেলার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ নেই এমপির। নড়াইলের এক এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে শুধু নিজের সংসদীয় এলাকায় নয়, গোটা জেলার রাজনীতিতেই নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করার। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় নিজের পছন্দ না হলে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধেই প্রার্থী দিয়েছেন। স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন তার নামে ‘লীগ’।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পীযূষকান্তি ভট্টাচার্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোথাও কোথাও এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু আওয়ামী লীগের মূল শক্তি তৃণমূল তো। জাতীয় সংসদসহ যে কোনো নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার ক্ষেত্রেও তারাই মূল দায়িত্ব পালন করে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে অনেক পদক্ষেপের একটি হিসেবে আমরা এই দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ নিয়েছি। তৃণমূলের সঙ্গে মতবিনিময়, কর্মিসভা, বর্ধিত সভার মাধ্যমে দূরত্ব কমানো হবে। দলীয় সভানেত্রী এজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর