শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী - ১১৮

লাশ লুকানোর ব্যর্থ মিশন

মির্জা মেহেদী তমাল

লাশ লুকানোর ব্যর্থ মিশন

নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে জালালের লাশ লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। খুনিরা ভেবেছিল, তারা এ যাত্রায় রক্ষা পেয়ে যাবে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। লাশ আর লুকানো থাকেনি। প্রকাশ্যে এসেছে। জালালের খুনি কে? তদন্তে এ প্রশ্নের জবাব যখন বেরিয়ে আসে, গোয়েন্দারা হতবাক। কোনোভাবেই তাদের মাথায় ঢুকছিল না যে, সন্ত্রাস দমন করা যাদের কাজ, তারা কীভাবে পেশাদার কিলারদের মতো মানুষ খুন করে। আর সেই লাশ-ই বা লুকিয়ে রাখতে বেছে নিয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘেরা গোয়েন্দা দফতরকেই (ডিবি)। ১৮ বছর আগে ৩৬ মিন্টো রোডের ডিবি ভবনের দোতলা ছাদে পানির ট্যাংকি থেকে একটি লাশ উদ্ধার হয়। পচে-গলে যাওয়ায় লাশটি শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। পাঁচ দিন পর শনাক্ত হয় লাশটি। লাশটি ডিবির সোর্স জালাল উদ্দীনের। তার স্বজনরা ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করেন। তদন্তে জানা যায়, গোয়েন্দা পুলিশের কতিপয় সদস্য ভবনের ছাদে নিয়ে জালালকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। লাশটি লুকিয়ে রাখতে পানির ট্যাংকিতে ফেলে ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়। ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ জালালের লাশ উদ্ধারের এ ঘটনাটি আলোড়ন তুলেছিল সারা দেশে। মানুষের জানমাল রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব সেই পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাই দানবীয় কায়দায় নৃশংসভাবে এক ব্যক্তিকে খুন করায় ক্ষুব্ধ হয় সাধারণ মানুষ। মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল তখন ডিবি পুলিশ।

যেভাবে উদ্ধার : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দফতরের ক্যান্টিনে খাবার পানিতে উৎকট গন্ধ পান পুলিশের এক সদস্য। ওয়াসার পানিতে এমন গন্ধ হতে পারে ভেবে তিনি বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। পরদিনও পানিতে প্রকট গন্ধ পান অনেকেই। সেদিন থেকে ডিবি  অফিসের কলের পানি ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। পানির লাইনের সমস্যা ঠিক করতে মিস্ত্রি আসেন। কিন্তু তারা লাইনের কোথাও কোনো ত্রুটি পান না। অফিসের ছাদে পানির ট্যাংকিতে ময়লা জমার কারণে দুর্গন্ধ হতে পারে- এমন ধারণা থেকে তা পরিষ্কারের জন্য দুজন লোক ডাকা হয়। তাদের নিয়ে পুলিশের কয়েক সদস্য মই বেয়ে দোতলা ভবনের ছাদে ওঠেন। তারা সিমেন্টের তৈরি ট্যাংকির ভারী ঢাকনা একটু খুলতেই ভিতর থেকে পচা গন্ধ বেরোতে থাকে। তারা ভেবেছিলেন, ইঁদুর বা পোকামাকড় মরে পচে আছে ট্যাংকির ভিতর। ঢাকনাটি ট্যাংকির ওপর থেকে অর্ধেক সরিয়ে ভিতরে উঁঁকি দিতেই ভয়ে কুঁকড়ে ওঠেন সবাই। মানুষের লাশ! পচে-গলে ফুলে যাওয়া লাশটি থেকে বিকট গন্ধ বেরোচ্ছিল। ট্যাংকি পরিষ্কার করতে আসা দুজনের একজন ভয়ে সেখানেই জ্ঞান হারান। ভীতসন্ত্রস্ত পুলিশ সদস্যরা কী করবেন, বুঝতে পারছিলেন না। ছাদ থেকে তারা নেমে আসেন দ্রুত। পুলিশ কর্মকর্তাদের জানান বিষয়টি। ফায়ার সার্ভিস এসে লাশটি ছাদ থেকে নামিয়ে আনে। এ লাশ উদ্ধারের মধ্য দিয়ে তৎকালীন ডিবি পুলিশের আসল রূপ প্রকাশ পায়। তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে যেন সাপ বেরিয়ে আসার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ফাঁস হতে থাকে ডিবি পুলিশের কতিপয় সদস্যের অন্ধকার জগতের অজানা কাহিনী। সোনা চোরাচালানসহ নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার নানা তথ্যও বের হয় জালাল হত্যার তদন্তে। এ ঘটনাটিকে ডিবির কলঙ্ক বলেও মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই।

জালাল খুনের পর গোয়েন্দা পুলিশ ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা চালায়। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সেটি আর করতে পারেনি তারা। তবে বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন এ মামলার আসামিরা জালালের পরিবারকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখান। এখনো বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় জালালের পরিবারের সদস্যরা হতাশ।

জানা গেছে, তদন্ত শেষে ডিবির তিন সদস্যসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। ২০০৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের ২০তম সাক্ষী ইমান আলী আংশিক সাক্ষ্য দিয়ে আর কখনই আদালতে যাননি। তখন থেকেই মামলার কার্যক্রম আটকে আছে। মামলার নথি থেকে জানা যায়, জালাল উদ্দীন ছিলেন ডিবির পরিদর্শক জিয়াউল আহসানের সোর্স ও মাইক্রোবাসের চালক। ১৯৯৯ সালের ১৯ মার্চ মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে শেষবার বের হয়েছিলেন। এরপর ২৫ মার্চ ডিবির ছাদ থেকে জালালের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩১ মার্চ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কাছে ছবি দেখে জালালের পরিবার লাশ শনাক্ত করে। লাশ উদ্ধারের পর রমনা থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) এস এম আলী আজম একটি মামলা করেছিলেন। এরপর নিহত জালালের ছেলে আব্বাস উদ্দিন ৪ এপ্রিল আরেকটি মামলা করেন। তদন্ত শেষে ডিবির পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। আসামিরা হলেন ডিবির পরিদর্শক মো. জিয়াউল আহসান, হাবিলদার মো. বিল্লাল, কনস্টেবল আবদুর রউফ এবং আনোয়ার হোসেন ও আবদুল মালেক। প্রথম তিন আসামি জামিনে আছেন। আনোয়ার মারা গেছেন। মালেক প্রথম থেকেই পলাতক। ২০০৩ সালে আংশিক জবানবন্দি দিয়ে সাক্ষী ইমান আলী আর কখনো আদালতে হাজির হননি। তাকে ও অন্য সাক্ষীদের হাজির হতে বার বার সমন জারি হলেও ফল হয়নি। এরপর ইমান আলীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও সাক্ষীদের হাজির করা যায়নি। মামলার অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সোনা ও মাদক পাচারের তথ্য পাওয়ার জন্য জালালকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করতেন পরিদর্শক জিয়াউল আহসান। এ মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জালালের তথ্যের ভিত্তিতে চোরাকারবারিদের আটক করে চোরাচালানের পণ্য বিধিসম্মতভাবে উদ্ধার না দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতেন। কিন্তু জালালকে কয়েকবার এর ভাগ দেওয়া হয়নি। সেই ক্ষোভে জালাল ১৯৯৯ সালের ১৩ মার্চ একটি সোনা চালানের তথ্য ডিবির অন্য একটি দলকে দিয়ে দিলে ক্ষুব্ধ হন জিয়াউল। ১৯ মার্চ রাতে অন্য আসামিদের মাধ্যমে জালালকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে খুন করা হয়। পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার পর ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ৪৫ জনের মধ্যে ১৯ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। সর্বশেষ ২০০২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯তম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর