মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

রূপা ধর্ষণ-হত্যায় চারজনের ফাঁসি

সেই বাসটি পাচ্ছে পরিবার

টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

রূপা ধর্ষণ-হত্যায় চারজনের ফাঁসি

রূপা

টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে রূপা গণধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় দিয়েছে আদালত। রায়ে পাঁচ আসামির মধ্যে চারজনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গতকাল টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আবুল মনসুর মিয়া এ দণ্ডাদেশ দেন। আদালতে পাঁচ আসামির উপস্থিতিতে বিচারক রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হচ্ছে ছোঁয়া পরিবহনের চালক হাবিব মিয়া এবং সহকারী শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীর আলম। গাড়ির সুপারভাইজার সফর আলী ওরফে গেন্ডুকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বেলা ১১টায় বিচারক এজলাসে আরোহণ করেন। ১১টা ২০ মিনিটে এই চাঞ্চল্যকর মামলায় ৭৩ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়া শুরু করে আদালত।

রায়ে বাদীপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছে, এ রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে এ মামলায় ন্যায়বিচার হয়নি উল্লেখ করে রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। মামলাটি বিচারিক আদালতে বদলি হওয়ার ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে এ রায় ঘোষণা করা হলো। রায়ে আদালত ছোঁয়া পরিবহন গাড়িটি ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিহতের পরিবারকে দেওয়ার আদেশ দিয়েছে। ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়ার জন্য কালেক্টর টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসককে নির্দেশ প্রদান করেছে আদালত। একই সঙ্গে আদালত মধুপুর থানা কর্তৃপক্ষকে ছোঁয়া পরিবহনের বাসটির মালিকানা নিহতের পরিবার বরাবর পরিবর্তন করে অত্র ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করার নির্দেশ প্রদান করেছে।

রায় শোনার পর নিহত রূপার বড় ভাই হাফিজুর রহমান বলেন, ‘রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি।’ এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষকে সহায়তা করেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের আইনজীবী এস আকবর খান, সিনিয়র আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী এম এ করিম মিঞা এবং মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সিনিয়র আইনজীবী আতাউর রহমান আজাদ। রায় ঘোষণার সময় তারা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আসামি পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে আদালতে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী শামীম চৌধুরী দয়াল এবং দেলোয়ার হোসেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নাছিমুল আক্তার নাছিম সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমরা মামলাটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। এ জন্য ন্যায়বিচারের স্বার্থে আমরা আদালতের কাছে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রার্থনা করেছিলাম। আমরা মনে করি এ রায়ের মধ্য দিয়ে আদালতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বাদীপক্ষ ন্যায়বিচার পেয়েছে। এখন এ রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি।’ অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামীম চৌধুরী দয়াল বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি প্রমাণ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এমন রায়ে আমরা বিস্মিত। আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব। সেখানে অবশ্যই ন্যায়বিচার পাব এবং আসামিরা বেকসুর খালাস পাবেন বলে আশা রাখি।’ দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলাটি শেষ হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান আজাদ বলেন, আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে। এতে করে কেউ আর এমন ঘৃণ্য অপরাধ করার সাহস পাবে না। গত বছর ২৮ আগস্ট এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ময়মনসিংহ-বগুড়া রুটের ছোঁয়া পরিবহনের চালক হাবিবুর (৪৫), সহকারী শামীম (২৬), আকরাম (৩৫) ও জাহাঙ্গীর (১৯) এবং সুপারভাইজার সফর আলীকে (৫৫) গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

রায়ে সন্তুষ্ট রূপার পরিবার : আইন বিভাগের ছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে চলন্ত বাসে গণধর্ষণ ও হত্যা মামলায় আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে নিহত রূপার পরিবার। রায়ে খুশি সুশীল সমাজের নেতারা ও এলাকার মানুষ। গতকাল টাঙ্গাইল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার পর তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রূপার মা হাছনাহেনা বানু বলেন, অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়ায় তিনি সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। রায় ঘোষণার আগ পর্যন্ত তিনি জায়নামাজে বসে ছিলেন। রায় শোনার পর তিনি নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করেন। তিনি বলেন, মেয়ের আত্মার শান্তি কামনায় তিনি রোজাও রেখেছেন। এখন সরকারের কাছে তার একটাই দাবি, রায় যেন দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়। তিনি যেন মৃত্যুর আগে আসামিদের রায় কার্যকর দেখে যেতে পারেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মেয়ের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘মেয়ে বলত ও পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের দায়িত্ব নেবে। মা আর ভাই-বোনদের জন্য সবকিছু করার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করত। রূপাকে নিয়ে কত যে আশা ছিল, কত যে স্বপ্ন ছিল, তা আর পূরণ হলো না। পাঁচ ধর্ষক ও হত্যাকারী তা পূরণ হতে দেয়নি।’ তিনি প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ রূপা ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের দাবিতে সরব দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ম ম আমজাদ হোসেন মিলন বলেন, রূপা হত্যার রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, অপরাধ করে রেহাই পাওয়া যাবে না। দৃষ্টান্তমূলক রায় দেখে সমাজের বখাটে ও অসৎ ব্যক্তিরা ভয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার সবার অধিকার বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর