মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

নির্বাচনে না এলে করার কিছু নেই

► স্যাটেলাইট ফোর জিসহ দিলেন তিন সুখবর
► রায় আমি দেইনি, দিয়েছে আদালত
► বিএনপিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার মতো একজনও পাওয়া গেল না?
► প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিন, শাস্তি দেব
► মিয়ানমারকেই রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান করতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্বাচনে না এলে করার কিছু নেই

খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়া এবং নির্বাচন হতে না দেওয়ার হুমকির জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিএনপি ২০১৪ সালেও নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি, এবারও পারবে না। আমরা জানতাম তারা গত নির্বাচনে আসবে। কিন্তু আসেনি। এখন কেউ যদি নির্বাচনে না আসে, সেখানে আমাদের করার কিছু নেই।’ তিনি বলেন, ‘মাল্টিপার্টি সিস্টেমে এখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র। কোন দল নির্বাচন করবে, কোন দল করবে না তা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। নির্বাচন সময়মতো হবে। জনগণও ভোট দেবে।’ গতকাল বিকালে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। ইতালি সফর শেষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ১০ মিনিটের লিখিত বক্তব্যের পর ঘণ্টাখানেক ধরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী।

লিখিত বক্তব্য শেষ করেই শেখ হাসিনা রসিকতাচ্ছলে বলেন, ‘শেষ, এবার যাই তাহলে।’ এরপর এক সাংবাদিক প্রশ্ন করতে দাঁড়িয়ে গেলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের তিনটি সুখবর দিই। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে কার্গো বিমান পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়েছে। আগামী মার্চের যে কোনো সময় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে যাবে।’ ফোর জি যুগে বাংলাদেশের যাওয়ার কথাও জানান তিনি। একে তথ্যপ্রযুক্তিতে ‘মাইলফলক’ হিসেবে অভিহিত করেন প্রধানমন্ত্রী।

বিএনপিকে উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তকে (খালেদা জিয়া) ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। রায় তো আমি দিইনি। এটা আদালত দিয়েছে। মামলা করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই সরকারও তাদের ছিল।’ তিনি বলেন, ‘এ মামলা ১০ বছর চলেছে। সেখানে ৮০ বারের বেশি রিট করা হয়েছে এবং সময় নেওয়া হয়েছে। জজের প্রতি তিনবার অনাস্থাও দেওয়া হয়েছে। জজও পরিবর্তন হয়েছে। এত কিছুর পরও তিনি ৪৩ দিন কোর্টে উপস্থিত ছিলেন। তারপর তার সাজা হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উনার (খালেদা জিয়া) প্রথম আইনজীবী রফিক-উল হক সাহেব কিন্তু বলেছেন, টাকাটা দিয়ে দেন। তখন কিন্তু আর মামলাটা থাকত না। টাকা দেননি। এতিমের টাকা খেলে শাস্তি আল্লাহও দেন, আদালতও দেন। আমাদের কিছু করার নেই।’ তিনি বলেন, সংবিধানে যেভাবে আছে, যারা জনগণের ওপর বিশ্বাস করে, তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। বিএনপি গায়ের জোরে বলতে পারে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। কারণ তাদের জন্মই হয়েছিল গায়ের জোরে। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপির আন্দোলনের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এত তাণ্ডব করেও তারা নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। কাজেই কেউ যদি বলে নির্বাচন করতে দেব না, এটা হচ্ছে গায়ের জোরের কথা। সেটা বিএনপি বলতে পারে। কারণ, তাদের জন্মই তো এভাবে। সায়েম সাহেবকে অস্ত্র ঠেকিয়ে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়া নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে দিলেন। তিনি একাধারে সেনাপ্রধান এবং প্রেসিডেন্ট। একই অঙ্গে দুই রূপ। ঠিক ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে দিয়ে আইয়ুব খান যেমন সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট। তারপর ‘হ্যাঁ-না’ ভোট। তারপর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। এসব করার পর বিএনপি দল করল। তাদের তো চরিত্রটাই এ রকম।

বিএনপির কি এতই দৈন্যদশা : তারেক রহমানকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার মতো একজন নেতাও কি পাওয়া গেল না! বিএনপির নেতৃত্বে কি এতই দৈন্যদশা। দলটির চেয়ারপাসনের কি দেশের কোনো নেতার প্রতি এতটুকু ভরসা নেই? তিনি বলেন, দেশে কাউকেই পাওয়া গেল না। অথচ বিদেশে থাকা পলাতক এক আসামিকে চেয়ারম্যান করতে হলো। দেশে থাকা একজন নেতারও কি চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতা নেই? ১/১১ সরকারের সময় গ্রেফতার হওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি গ্রেফতার হওয়ার পরপরই জিল্লুর রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছি। আমার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কাউকেই এ দায়িত্ব দিইনি। যোগ্যতা অনুযায়ীই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’ বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা পরিবর্তনের কড়া সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘যাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো সে তত্ত্বাবধায়কের আমলে রাজনীতি করবে না বলে মুচলেকা দিয়ে বিদেশে চলে গেল। এফবিআইর তদন্তে অপরাধী প্রমাণিত হয়ে সে সাজাপ্রাপ্ত। বিএনপিতে এখন যারা আছেন, তাদের দেখছি খুবই কাজ করছেন, খুব কর্মঠ। তাদের মধ্যেও কি একজন নেতা পাওয়া গেল না, যাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা যায়?’

খালেদা গ্রেফতারে কোনো ফোন পাইনি : যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে ফোন পেতেন। এবার একটি বড় দলের নেত্রীর জেল হলো। এখন কোনো ফোন পেয়েছেন কিনা— জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলার রায়ের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কেউ ফোন করেনি। কেউ কোনো প্রশ্নও করেনি। যাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে তারা কিছু জানতেও চাননি। সেদিক থেকে এটি একটি ভালো লক্ষণ। দুর্নীতিবাজদের পক্ষে কেউ কিছু বলে না।

ফাতেমা নতুন নয়, আগেও ছিল : প্রধানমন্ত্রী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমাকে শ্যাওলা ধরা একটি ভবনে রাখা হয়েছিল। খাট ছিল ভাঙা। আর তাকে (খালেদা জিয়া) রাখা হয়েছিল স্পিকারের বাড়িতে। তখনো তার সঙ্গে এই ফাতেমাকে দেওয়া হয়েছিল। এটা গোপন ছিল। ডিআইজি হায়দার (সামছুল হায়দার সিদ্দিকী) সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন। আদালত দিয়েছেন। বেশি কিছু তো দেওয়ার নেই। একজন মেইড সার্ভেন্ট দিয়েছে। যদি আরও কিছু ডিমান্ড করে তখন কী করবেন?

প্রশ্নপত্র ফাঁস নতুন কিছু নয় : প্রশ্নপত্র ফাঁসসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে এটা চলে আসছে। কখনো এটা সামনে চলে আসে, কখনো আসে না। প্রযুক্তি যেমন সুযোগ তৈরি করে দেয়, আবার সমস্যাও তৈরি করে। তিনি বলেন, পরীক্ষার আগের দিন তো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় না। প্রশ্ন ফাঁস হয় পরীক্ষার ২০ মিনিট আগে। কার এমন ‘ফটোজেনিক মেমোরি’ আছে যে প্রশ্ন দেখে ২০ মিনিটে সবকিছু মুখস্থ করে লিখে ফেলে? তিনি বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’ বলে একটি সুর তুলে দেওয়া হচ্ছে। তাই বলে মন্ত্রী, সচিবকে চলে যেতে হবে? তারা তো এটা ফাঁস করেননি। গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিন, তাদের শাস্তি দেব। পরীক্ষায় এমসিকিউ প্রশ্ন বন্ধ করে দেব। আপনারা (গণমাধ্যমকর্মীরা) লিখুন। আমরা বন্ধ করে দেব। কিন্তু এটা নিয়ে সুর তুলে একবার মন্ত্রী, সচিব আবার সরকারকে দায়ী করা হচ্ছে। দয়া করে একটু খুঁজে দিন, কে প্রশ্ন ফাঁস করল, তার শাস্তি দেব আমরা।

অপকর্ম না করলে ৩২ নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই : সম্ভাব্য নতুন ডিজিটাল আইন সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাইবার ক্রাইম একটি বিরাট সমস্যা। সারা বিশ্বে এ সমস্যা আছে। আপনাদের (সাংবাদিক) এত ভয় কেন? কেউ যদি এমন অপরাধ করেন, তাহলে তার ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ হবে। ফৌজদারি আইন (সিআরপিসি) অনুযায়ী কেউ অপকর্ম না করলে সেখানে অপপ্রয়োগ কেন হবে! প্রযুক্তি যেমন সুযোগ করে দেয়, মাঝেমধ্যে দুঃসহ যন্ত্রণাও দেয়। নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি পাঠানোয় দেরির কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে টেলিভিশন সাংবাদিকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো হবে বলে জানান তিনি।

রোহিঙ্গাদের জন্য ঘর বানানো হচ্ছে : শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা বলছি, সমস্যা সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার, সমাধান তাদেরই করতে হবে। এখন একটা সমঝোতা হয়েছে। এখন আট হাজার পরিবারের তালিকা তৈরি। এজন্য আমাকে ধন্যবাদ দিতে পারেন যখন ঢোকা শুরু হলো, তখনই প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে টাকা দিয়ে তালিকা এবং বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করেছি। যারাই ঢুকেছে, তাদের ছবি নিয়ে তাদের আইডি কার্ড করিয়ে রেখেছি। এখন মিয়ানমার অস্বীকার করতে পারবে না যে এরা তাদের নয়।’ তিনি বলেন, বালুখালী-কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গারা আছে। তাদের জন্য একটি দ্বীপে ঘরবাড়ি করা হচ্ছে। সেখানে যেন জোয়ারের পানি না ঢোকে সেজন্য বাঁধ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বালুখালী-কুতুপালংয়ে গাছপালা সব কেটে শেষ। যত দ্রুত পারা যায়, তাদের স্থানান্তর করা হবে। রোহিঙ্গাদের নিতে মিয়ানমার টালবাহানা করছে। এটা তাদের চরিত্র। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিকভাবেও চাপ আসছে প্রচুর। একবার যদি যাওয়া শুরু করে তাহলে স্রোতের মতো করে চলে যাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের এক কোটি শরণার্থী ছিল। তারা কীভাবে চলে এসেছিল?’

চালের দাম বাড়ানোর জন্য মিডিয়ার অবদান আছে : এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, চালের দাম সিন্ডিকেটের জন্যও বাড়ে, আবার মিডিয়ার প্রচারের জন্যও বাড়ে। তিনি বলেন, ‘আমরাও চালের দাম কিছুটা বাড়ানোর কথা চিন্তা করেছিলাম, যেন কৃষক ন্যায্য মূল্য পায়। আমরা আগে কাজের বিনিময়ে টাকা দিতাম, এখন কাজের বিনিময়ে খাদ্য দেব; যাতে খাদ্যগুলো গ্রামে যায় এবং খাদ্য সরবরাহ বাড়ে।’

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর