মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

চাই স্বাস্থ্যবান মাতৃভাষা

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

চাই স্বাস্থ্যবান মাতৃভাষা

ভাষার মাসে আমি ভাষার সব রূপের বিকাশ চাই। স্বাস্থ্যবান মাতৃভাষা চাই, যা পরনির্ভর এবং অসুখপ্রবণ নয়। যার ভিতরের গানটা সুর-তাল হারাবে না। ভাষা ব্যবহারের প্রথম তালিমটি একটি সন্তান পায় তার মা, বাবা অথবা পরিবারের অন্য কারও থেকে। তারপর স্কুলে। এই দুই জায়গাতেই এখন একটি সচেতনতার অভাব দেখা দিয়েছে। পরিবারের ক্ষেত্রে অভাবটা সময়ের অথবা ইচ্ছার অথবা সামর্থ্যের। স্কুলের ক্ষেত্রে সুযোগের। এখন যে পরীক্ষাপ্রবণ, মুখস্থ প্রধান শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে, তাতে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে সৃজনশীল ভাষা ব্যবহারের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। এখন মুখস্থ চর্চাই নিয়ম। শিক্ষকেরা এই নিয়মের বাইরে যেতে চান না। যে শিক্ষাব্যবস্থা কল্পনাশক্তিকে জাগায় না, মনের দরজা-জানালাগুলো খুলে দেয় না, শিক্ষার্থীর ভিতর তার চারপাশ ও বিশ্বকে নিয়ে কৌতূহল জাগায় না, সেই শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষাচর্চাও হবে ধরাবাঁধা। সেটি সবল এবং সৃজনশীল হবে, তেমন ভাবার কারণ নেই। ভাষার মাসে শিক্ষা নিয়েও লড়াই করার একটা অঙ্গীকার আমাদের করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষায় কেন শিক্ষা দেওয়া হয় না, সেই প্রশ্ন তুললে বলা হয়, তাহলে বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমরা কোনো দিনই পেরে উঠব না। ভালো কথা, ইংরেজিতে পড়াশোনা করে আমরা বিশ্বকে হারাব, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব রাস্তায় হেঁটে আমরা মণিমাণিক্য কুড়াব। কিন্তু তা তো আর হয়নি। প্রকৃত অবস্থাটা হলো, আমরা ইংরেজিতে অতিশয় দুর্বল। যদি বুঝতাম ইংরেজিটা তেমন না শিখতে পারলেও বাংলা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, তাহলেও হতো। কিন্তু এখানেও বাস্তবতা ভিন্ন। মাতৃভাষায় নির্ভুলভাবে লেখা ও বলার ক্ষেত্রে আমাদের সামর্থ্য হতাশাজনক। মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের লড়াইটা এখন আর এর অধিকার প্রতিষ্ঠাতেই সীমাবদ্ধ নয়। লড়াইটা এর যথাযথ শিখন, ব্যবহার ও চর্চা এবং এর বিকাশ নিয়েও। বাংলা এখন ভয়ানক মিশ্র একটি ভাষা। সব ভাষাই কমবেশি মিশ্র ভাষা, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ভাষার অনেক রূপের মধ্যে একটি থাকে যা ব্যবহৃত হয় এর সৃজন ও মননশীল কল্পনা প্রকাশে। এই ভাষাটি সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন সাধনা ও উন্নত চিন্তার প্রকাশের মাধ্যম। এর বাইরে আঞ্চলিক ভাষা থাকে, কথ্য ভাষা থাকে, খিস্তিখেউড়ের এবং চৌরাস্তার ভাষা থাকে। মাতৃভাষা নিয়ে এখন বাঙালিদের লড়াইয়ের চরিত্রটা পাল্টে গেছে। একটা সময় ছিল-স্বাধীনতার কিছুকাল পর পর্যন্তও-যখন বাঙালি মাত্রই ধরেই নিত, স্বাধীন বাংলাদেশে মাতৃভাষা হবে শিক্ষার মাধ্যম; এই ভাষায় সরকারি, বেসরকারি, বিচারিক সব কাজ করা হবে। এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যও বাংলাকে প্রধান মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করবে। স্বাধীনতার পর ৪৭ বছর চলে গেল— এখনো শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ব্যবহার সর্বজনীন নয়, উচ্চ আদালতের কাজকর্ম চলে ইংরেজিতে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাষা, তথাকথিত করপোরেট ভাষা শুরু থেকেই ইংরেজি। সরকারি দফতরে বাংলার ব্যবহার আছে এবং সেটি প্রশংসনীয়, কিন্তু যথাযথ পরিভাষার অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই ইংরেজির আবশ্যকতা থেকেই গেছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর