শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল

মাথাপিছু আয় মানব উন্নয়নসহ তিন সূচকের শর্ত পূরণ

রুহুল আমিন রাসেল

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল

বাংলাদেশ আজ থেকে বিশ্ববাসীর কাছে ‘উন্নয়নশীল দেশ।’ আজ ‘স্বল্পোন্নত’ দেশ থেকে উন্নয়নশীলের গৌরবময় মর্যাদা অর্জনের দিন। আজকের ভোর এদেশের মানুষকে বিশ্বের বুকে আরেকবার মাথা উঁচু করাল। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনও আজ। এই দিনেই উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। স্বাধীনতার মাসে এই ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন উদ্যাপনে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ড. মাসুদ বিন মোমেন গতকাল রাতে নিউ ইয়র্ক থেকে টেলিফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করে বলেন, প্রথমবারের মতো এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করল বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার এই সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবারই হয়েছে। এতদিন বাংলাদেশ উন্নয়নশীল ক্যাটাগরির সবচেয়ে নিচের স্তরে ছিল। এর ফলে যেসব সুযোগ-সুবিধা পেতাম, তা আরও ছয় বছর পর্যন্ত পাবে বাংলাদেশ। আগামী ছয় বছরে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে নতুন নতুন সুবিধার দ্বার উন্মোচন হবে বলে মনে করেন এই পেশাদার কূটনীতিক। বিশ্ব এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। চরম ভঙ্গুর অর্থনীতির বাংলাদেশ, এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ হয়েছে। মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা যেমন বেড়েছে, তেমনি মাথাপিছু আয়ও বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থার তথ্যমতে, একটি দেশ স্বল্পোন্নত বা লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রি— এলডিসি থেকে বের হতে যে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়, তা আগেই সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ। এই তিন শর্ত হলো— মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় তিন বছরের গড় হিসেবে ১ হাজার ২৪২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হওয়া। বাংলাদেশে এখন মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলার। আর মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে ১০০-এর মধ্যে ৬৬ বা তার বেশি অর্জন করতে হয়, বাংলাদেশের অবস্থান ৭০-এ। আর অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ বা তার নিচে থাকার শর্ত রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান ২৫.০৩-এ। বিবিএসের এসব তথ্যের সঙ্গে জাতিসংঘের তথ্যের কিছুটা ফারাক ছিল। সম্প্রতি ইউএনসিডিপির প্রতিনিধিদের সফরের সময় উভয় পক্ষের আলোচনায় এই ফারাক কমে গেছে। ফলে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা—এলডিসির তকমা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া আজ থেকে শুরু হলো বাংলাদেশের। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ গতকাল বিকালে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতিসংঘ ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আজ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার স্বীকৃতির পত্র দেবে। এই পত্র ২২ মার্চ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করা হবে। এতে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আরও জানিয়েছে, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সাফল্য অর্জনের কর্মসূচি হিসেবে ২০ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী সরকারের সব বিভাগের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি পালন করা হবে। এ সময়ে দেশের সব এনজিও, বেসরকারি সংস্থা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানায় মালিক-শ্রমিক সাফল্য উদ্‌যাপন উৎসব করবে। এতে থাকবে শ্রমিকদের মধ্যে ভালো খাবার পরিবেশন করার পাশাপাশি পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নকরণ। এর বাইরে সারা দেশে রোডশো হবে। ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় হাতিরঝিলে হবে লেজার শো। একই দিন রাজধানীর একটি হোটেলে আন্তর্জাতিক সেমিনার হবে। জানা গেছে, ৪৭টি স্বল্পোন্নত দেশ—এলডিসিতে স্বাধীনতার পরপরই সদস্য হয় বাংলাদেশ। এই গ্রুপের সদস্য হিসেবে থাকলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। আবার অসুবিধাও আছে। ব্র্যান্ডিংয়ের অসুবিধা আছে। এলডিসি দেশের কাতারে থাকলে কিছুটা রেটিংয়ে সমস্যা হয়। ২০২১ সালে মধ্যআয়ের দেশ ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে যেতে চায় বাংলাদেশ। তবে আরও ছয় বছর এলডিসির সুযোগ-সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এই ছয় বছরের মধ্যে তিন বছর করে দুই টার্ম বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এ সময়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে বাংলাদেশ প্রস্তুতি নেবে। তবে নিজ থেকে বেরিয়ে অতীতে অনেক দেশ আবার এলডিসিতে প্রবেশ করেছে। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এমপি গত সপ্তাহে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর রোল মডেল হতে পারে। তবে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বৈশ্বিক অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। কিন্তু পরিকল্পনা-মাফিক কাজ করতে পারলে জিএসপি প্লাসসহ অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় ইউরোপে পাওয়া জিএসপি সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই জিএসপি প্লাসের জন্য ব্রাসেলসে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। পূর্ব ইউরোপে আমাদের তৎপরতা আরও বেশি বাড়াতে হবে। বৈশ্বিক পর্যায়ে বাণিজ্য বাড়াতে জোর দেব। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রস্তুত রয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট— পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর অবশ্য মনে করেন, এলডিসি থেকে বের হওয়ার জন্য যেসব প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ তার কিছুই করেনি। তিনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এলডিসি থেকে বের হওয়াটা এখন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এতে কিছু সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। বাণিজ্য ও সাহায্যে প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে চীনের মতো উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। যেসব সুবিধা চলে যাবে, তার বিপরীতে ভালো সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তারও তিন বছর পর ২০২৭ সাল পর্যন্ত এলডিসি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে এই ১০ বছর নিজেদের সক্ষমতা গড়তে প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাওয়া যাবে। এ সময়ে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে আরও বেশি চতুর হতে হবে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের এই কর্মকর্তা।

তবে জাতিসংঘের সদর দফতর নিউইয়র্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী আবাসিক প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত ড. মাসুদ বিন মোমেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে আগেই জানিয়েছিলেন, এলডিসি তকমা বাংলাদেশের অগ্রগতির স্বপ্নের সঙ্গে যায় না। তার মতে, এলডিসি থেকে বের হলে বিদেশি ঋণ ও বেসরকারি বিনিয়োগ ভালো পাবে বাংলাদেশ। আরেকটি বিষয় হলো— জিএসপিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে খুব একটা সুযোগ পায় না বাংলাদেশ, তাই তেমন ক্ষতি হবে না। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে চুক্তি ও সমঝোতা করতে হবে বাংলাদেশকে। এটা ব্যবসায়িক নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে নিতে হবে।

জানা গেছে, এলডিসি থেকে বের হলে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধাসহ আরও বেশ কিছু সুবিধা হাতছাড়া হবে বাংলাদেশের। বর্তমানে এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিনা শুল্কে রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশের ৩৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের ২৭ বিলিয়ন ডলারই আসে এসব দেশ থেকে। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে কম সুদে বা বিনা সুদে ঋণ সহায়তা পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে চড়া সুদে ঋণ নিতে হবে। ২০২৭ সালের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুবিধা কমে যাবে। প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সাল থেকে জাতিসংঘ বাংলাদেশসহ বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ‘এলডিসি’ তালিকায় রেখেছে। এসব দেশ নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান আংকটাডের নেতৃত্বে সম্মেলন হয়েছে। সর্বশেষ তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ২০১১ সালের সম্মেলনে এলডিসির অভিধায় থেকে বের হওয়ার জন্য কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় পায় দেশগুলো। ২০২০ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা ৪৮ থেকে অর্ধেকে নামিয়ে আনার চিন্তা করছে জাতিসংঘ। সরকারের এ সাফল্যের সুফল নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও দেশের প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ এখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অবস্থানে। এখনকার অর্থনীতি প্রশংসনীয়। এই অর্থনীতি বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ওপর নির্ভরশীল নয়। খাদ্যশস্য উৎপাদন, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, অর্থনৈতিক ডিজিটালাইজেশনে অনেক সাফল্য আছে সরকারের। তবে দুর্নীতি দমনে সরকার মোটেও সাফল্য দেখাতে পারেনি। দুর্নীতিই বাংলাদেশের উন্নয়নে সবচেয়ে প্রধান বাধা বলেও মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের এই শিক্ষক। দেশের প্রাচীন বাণিজ্য সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক আফতাব উল ইসলাম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের অর্থনীতির সব সূচকই এখন ভালো। সামনের নির্বাচনের আগে আরও ইতিবাচক হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর