শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

সুখের নাম যেখানে মৃত্যু

মির্জা মেহেদী তমাল

সুখের নাম যেখানে মৃত্যু

বাবা তুমি কবে আসবা? কতদিন তোমারে দেখি না। জানো বাবা, শাহিন স্কুলে ফার্স্ট হয়েছে। হ্যাঁরে মা, আসব। এই তো আর বেশি দিন নয়। ফোনে মেয়ে বিউটির কথা শুনে আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন মইনুল। মালয়েশিয়া প্রবাসী মইনুল তার মেয়েকে নিজের অনেক কথাই বলতে পারছিলেন না। এমনভাবে কথা বলছিলেন মেয়ের সঙ্গে, যেন অনেক ভালো আছে। ভালো ভালো খাবার খাচ্ছে। বাড়ির জন্য প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিসপত্র কিনে ব্যাগে ভরছেন। কান্না চাপা দিয়ে খুব কষ্ট করে কথা বলতে হয় মইনুলকে।

মইনুল নাটোর থেকে ভাগ্য ফেরানোর আশায় জায়গা জমি বিক্রি করে অর্থ তুলে দিয়েছিলেন দালালের হাতে। দালাল তাকে নাটোর থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের জঙ্গল পেরিয়ে সাগরে মাছধরা ট্রলারে তুলে দেয়। এরপর জাহাজে খেয়ে না খেয়ে রোদ বৃষ্টি, ঝড়, উত্তাল সাগরের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইন্দোনেশিয়ার জঙ্গলে। সেখানে মানবেতর জীবনযাপনের একপর্যায়ে মালয়েশিয়ার জহুর প্রদেশে প্রবেশ করানো হয়। জহুর প্রদেশে এখানে-সেখানে অবস্থান করানোর একপর্যায়ে এক কারখানায় কাজ মেলে। কিন্তু তার বাইরে যাওয়া বারণ ছিল। কারণ পাসপোর্ট নেই, ভিসা নেই! শুরু হলো বন্দীজীবন। দালাল টাকা নেয় কাজ দেওয়ার জন্য মাসে মাসে। মাস শেষ হলেই বেতনের এক তৃতীয়াংশ নেয় দালাল। এরপর পাসপোর্ট ও পারমিট করে দেওয়ার জন্য নেয় হাজার হাজার রিঙ্গিত। সব মিলে এত দেনা শোধ হয় বেতন থেকে মাসে মাসে। এরপর যা থাকে তাই দিয়ে চলে খাওয়া, থাকা। যতসামান্য কিছু অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পাঠাতে পারে। প্রিয়জনের মুখগুলো যখন ভেসে ওঠে আনন্দে, ঝিলিক দেয় মন। এভাবে চলতে থাকে জীবন, শখ, আহ্লাদ, বঞ্চিত জীবন যেন কাজ করার আর অর্থ আয়ের মেশিন—আবেগ, অনুভূতি চলে না। মাঝে মাঝে মোবাইলে মিথ্যা কথা বলতে হয় যে—খুব ভালো আছেন। পরিবারের কে কেমন আছে? জানে না ছেলেমেয়ে কত বড় হয়েছে? মেয়ের কি বিয়ে দিতে হবে? মানুষ ওদের কি বলে? মেঠো পথ, চির সবুজ গ্রাম, প্রতিবেশী, বন্ধু সব যেন এখন স্বপ্ন সান্ত্বনা। ইদানীং খুব স্বপ্নে দেখা হয় প্রিয়জনদের সঙ্গে। মন আকুলি বিকুলি করে ওঠে। পাশের সহকর্মী বলেন, নে এবার বাড়ি যা, অনেক তো হলো। কীভাবে যাবে ভিসা নাই, সে তো অবৈধ। সেই দালালের কাছে গিয়ে বলে, দেশে যাব পাসপোর্ট যদি দিতেন। আহা! যেন দেশে যাওয়ার অধিকারটুকুও নেই! প্রবাসে একমাত্র আইডি পাসপোর্ট তাও নিজের কাছেই রাখতে পারে না। দালাল বলে, তুই দেশে যাবি ক্যান? তোর ভিসা নাই। স্পেশাল পাস করাতে হবে। খরচ কত হবে জানিস? আমি মুখ্যসুখ্য মানুষ অত কিছু বুঝি না। খরচ যা হয় দেব। আপনি ব্যবস্থা করেন। বাড়ির জন্য মনটা কাঁদছে। আর ভালো লাগছে না। চলে যেতে পারলে বাঁচি। এসব বলেই হাতে পায়ে ধরে দালালের। দালালের রক্তচক্ষুু চোখে চোখ পড়ে মইনুলের। আর বেশি কিছু বলার সাহস হলো না। যদি আবার মারধর করে। এ পর্যন্ত যত মারধর খেয়েছেন তার গোষ্ঠীর সবাই মিলেও অত মার খায়নি! ভাবে মইনুল। হায়রে কপাল! মাঝেমধ্যে মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছু করতে পারে না। যদি আরও বিপদ নেমে আসে! এক দিন দালাল এসে বলে, দেড় লাখ টাকা লাগবে। কি পারবি? জি, কিছুদিন সময় দেন—বলে মইনুল। বেশ কদিন ধরে শরীর ভালো যাচ্ছে না। এর মধ্যে শরীরের ডান পাশটা কেমন যেন করে! হাত দিয়ে ঠিকমতো কাজ করা যায় না। এর মধ্যে এক দিন বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে পড়ে যায়। তাকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যায় অন্য শ্রমিকরা। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, এক সাইট প্যারালাইজড। হাঁটতে পারবে না! এত দুঃখ এ জীবনে ছিল। হুহু করে কেঁদে ওঠে মইনুল। সবাই সান্ত্বনা দেয়। মন মানে না তার। দালাল এসে বলে, তুই একা যেতে পারবি না। সঙ্গে একজন লোক দিয়ে দিতে হবে। পরে কিছু হলে তো আসামি হতে হবে আমাকে। তার খরচ দিতে পারবি? আবার খরচ! বুকের ভিতর খচ করে ওঠে মইনুলের। চোখে অন্ধকার দেখে। তাহলে কি দেশে যেতে পারবে না! আর ভাবতে পারে না কাশি ওঠে শরীর গরম। দেশে কথা বলে মইনুল। কিছু টাকা জোগাড় করে একজনকে ঠিক করা হলো। হায়রে কপাল! যে এক দিন টাকা পাঠাত তাকেই আজ দেশ থেকে টাকা আনতে হচ্ছে! দিন ক্ষণ ঠিক হয়, খুশিতে মন নেচে ওঠে। শরীর কেমন চাঙ্গা চাঙ্গা লাগে। সবাই বলে, ‘কিরে তুই যে সুস্থ হয়ে গেলি!’ হ সেরকমই মনে হচ্ছে। দেশে যাবরে ভাই। আসছিলাম পানিতে ভেসে, এবার যাব হাওয়ায় ভেসে। ভাই বিমানে হাওয়া উড়তে কেমন লাগেরে! ইমিগ্রেশনে জরুরি কাজের কথা বলে দালাল জহুর কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে একজন সহযোগীসহ রেখে যায়। এইখানে চেক ইন করে তোরা চলে যাবি। আর কোনো সমস্যা নেই, বুঝলি।  মনে মনে অসন্তোষ থাকলেও রক্তচোষা জোঁকটাকে এই প্রথমবার মানবিক মনে হলো। বলল, বস, অনেক সময় ভালো আচরণ করিনি, ক্ষমা করে দিয়েন। দালাল বলে, আরে থাক। আর আহ্লাদ করতে হবে না। তোরা তো এখানে এসে আমাদের উদ্ধার করেছিস মনে হচ্ছে। সব কিছুই তোদের জন্য করতে হচ্ছে। এই তো চলতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারি মালিন্দ এয়ারের চেক ইন কাউন্টারে দুজন দাঁড়িয়ে আছে কোনো রকমে। মইনুলের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। আলো ঝলমল এয়ারপোর্টে যেন অন্ধকার নেমে এলো। যখন আলো এলো মইনুল নিজেকে দেখল একটা বেডে শুয়ে আছে। নড়ার শক্তি যেন শেষ! জানতে পারল। ডাক্তার তাকে দেখেছে, স্ট্রোক করেছে, মাথায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। চলার শক্তি নেই। চিকিৎসা দরকার। এ অবস্থায় বিমানে ফ্লাই করতে হবে না, হাওয়ায় ভাসা হলো না! মনটা আরও খারাপ হলো, তবে কি দেশে যেতে পারবে না! সঙ্গের লোকটিও চলে গেছে। সে এখন একা!  বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন তার সঙ্গে কথা বলল। কথা বলল তার মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে। হাসপাতালে ভর্তি হবে— কিন্তু খরচ দেবে কে? এমনিতেই অবৈধভাবে মালয়েশিয়া এসেছে। এখনো বৈধ নয়। বৈধভাবে আসলে সরকারি সব সুবিধা পায়, কিন্তু সে পাবে না! তথাপি সারডাং হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে এগিয়ে আসেন কমিউনিটির একজন। নাম শাহ আলম। তিনি শ্রমিকদের জন্য কাজ করেন।  হাসপাতালে কত লোক আসে তাকে দেখতে, হাইকমিশনের লোক আসে। ডাক্তার জানাল বিশ হাজারের বেশি রিঙ্গিত লাগবে অপারেশন করতে। কিন্তু তার শরীর অপারেশন করার উপযুক্ত নয়। অনুরোধ করা হলো বিমানে চড়ে দেশে যাওয়ার উপযোগী করতে। এতে খরচ অর্ধেক হবে। ডাক্তার বললেন, ‘দেখি আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’ ক্রমে দেখা দিল ফুসফুসে ইনফেকশন, জ্বর, শরীর অত্যধিক দুর্বল, মুখে খেতে পারে না, শরীরের ডান পাশ অবশ, ডাকলে সাড়া নেই, নিজে শ্বাস নেওয়ার জো নেই, মেশিন দিয়ে শ্বাস চালু রাখা হয়েছে— বুকটা অনেক ওঠা নামা করে আর শব্দ হয়। সব অনুভাব যেন নিস্তেজ। কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকলেও সাড়া নেই, চোখ দুটো খোলা কিন্তু অনুভূতি নেই চোখের পলক পড়ে না। নিস্তেজ চোখ। ডাক্তার বললেন, ফ্লাই করার মতো অবস্থা নেই। বিমানে নিলেই মারা যাবে। হ্যাঁ বিমানে হাওয়ায় ভেসে মইনুল ঠিকই দেশে গেলেন। কিন্তু জানলেন না হাওয়ায় ভাসার সুখ কেমন! জেনে গেলেন শুধু পানিতে ভাসার বেদনা। শুনল না বিমানবন্দরে প্রিয়জনের আহাজারি! চলতি বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে মইনুল অবশেষে মারা গেলেন সারডাং হাসপাতালে। সুখের আশায় দেশ ছেড়েছিলেন মইনুল। কিন্তু সেই সুখ আর তাকে ধরা দেয়নি। সেই সুখের পরিণতি হয়েছিল শুধুই করুণ মৃত্যু। সমুদ্র পথে দেশ ছেড়ে এভাবে কয়েকশ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। কেউ সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে গেছেন। কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন নির্যাতনের শিকার হয়ে। কেউ মারা গেছেন মইনুলের মতোই ধুঁকে ধুঁকে। আর কেউ যদি ভাগ্যক্রমে জীবন নিয়ে ফিরেছেন, তারা আর সুস্থ জীবনে ফিরতে পারেনি। বিছানাই তাদের ঠিকানা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমুদ্র পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুদের আগেভাগে টাকা দিতে হয় না। সংঘবদ্ধ পাচারচক্রের কথামতো যাত্রীদের ট্রলারে পৌঁছে দিতে পারলে দালালরা উল্টো জনপ্রতি টাকা পাচ্ছে। আর এ কারণে এখন অপহরণের পর জিম্মি করে অনেকেই ট্রলারে পৌঁছে দেয়। মাঝপথে জিম্মি করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায়কে টার্গেট করে মানবপাচারকারীরা এ কৌশল অবলম্বন করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় মাঝে মধ্যে এই যাত্রা বন্ধ হয়। কিছুদিন পর আবারও শুরু হয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশ যাত্রা মানেই মৃত্যু। এ কারণে এ পথে গিয়ে কারও মৃত্যু মানেই একটি পরিবারের মৃত্যু। একটি পরিবারের মৃত্যু মানেই হলো, প্রতিটি সদস্যের অনিশ্চিত জীবন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর